ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন শহর ও এলাকায় অপরাধের হার বৃদ্ধি পায়, দেখা যায় অরাজকতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবর্তমানে ও অপরাধের মাত্রার কারণে সামাজিকভাবে চাপ তৈরি হয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয় তরুণ ও বাসিন্দাদের যুক্ত করে কাজ করার উদ্দেশ্যে চালু হয়েছে প্রতিরোধ ডটনেট ওয়েবসাইট। প্রতিরোধ একটি রিয়েল-টাইম কমিউনিটি সুরক্ষা প্ল্যাটফর্ম। ওয়েবসাইটটিতে প্রবেশ করলেই গত ৩০ মিনিটে ডাকাতের আক্রমণবিষয়ক কতটি অভিযোগ জমা হয়েছে, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানা যায়। এরপর ‘বর্তমান পরিস্থিতি লাইভ মনিটর করুন’ ট্যাবে ক্লিক করে নিজের অবস্থানের তথ্য নির্বাচন করলেই আশপাশের কোনো স্থানে ডাকাত আক্রমণ করেছে কি না, সে তথ্য গুগল ম্যাপে দেখা যায় ওয়েবসাইটটিতে। ফলে আশপাশে থাকা ব্যক্তিরা সহজেই একত্র হয়ে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে ডাকাত প্রতিরোধ করতে পারেন।
সামাজিক উন্নয়নে আগ্রহী তরুণ ও স্বেচ্ছাসেবকেরা আলাদাভাবে কাজ করার কারণে সঠিক সময়ে দ্রুত সহায়তা পাওয়া যায় না। সেই ক্ষেত্রে কাজ করছে প্রতিরোধ, যার মাধ্যমে যে কেউ প্রয়োজনীয় সহায়তা পেতে পারেন এই ওয়েবসাইট থেকে। ওয়েবসাইটটিতে বর্তমান পরিস্থিতি তাৎক্ষণিকভাবে পর্যবেক্ষণ করার পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টায় যত অভিযোগ বা রিপোর্ট জমা পড়েছে, তা–ও দেখা যায়।
সবাইকে যুক্ত করছে প্রতিরোধ
প্রতিরোধ ডটনেটের উদ্যোক্তা দুই তরুণ ফাহিম মুর্শেদ ও মারওয়া কাজী মোহাম্মদ। সহ–উদ্যোক্তা ফাহিম মুর্শেদ আজ সোমবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বর্তমান বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি করেছি প্রতিরোধ ডটনেট। সাম্প্রতিক পরিস্থিতির শুরুর দিকে এলাকাভিত্তিক অনেক কাজ আমরা দেখেছি, কিন্তু সমন্বয় ছিল না। ফেসবুকে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। আমরা একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সব তথ্য সংগ্রহের কাজ করছি। এটি একটি প্ল্যাটফর্ম, যা কমিউনিটির সুরক্ষা বাড়াতে রিয়েল-টাইমে ঘটনা রিপোর্টিং ও পর্যবেক্ষণ করে।’
প্রতিরোধ ডটনেটে ৮ আগস্ট ওয়েবসাইটটি সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা হয় বলে জানান ফাহিম মুর্শেদ। তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত সাড়ে তিন হাজারের বেশি রিপোর্ট এতে জমা পড়েছে। ৮ ও ৯ আগস্ট আমাদের ওয়েবসাইট সাড়ে তিন লাখ বারের বেশি দেখা হয়েছে। বিভিন্ন ঘটনার মাত্রা বোঝার জন্য সতর্কতা ও ঘটনা নামে দুটি ভাগে ভাগ করা হচ্ছে। যেসব ঘটনা সতর্কতা ধরনের, তা কমলা রং দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। যেসব ঘটনা বা পরিস্থিতি মারাত্মক ও খারাপ, সেগুলো লাল রঙে চিহ্নিত করা হয়। এখানে ব্যবহারকারীরা মতামত জানাতে পারেন। ঘটনা বা সতর্কতা সম্পর্কে মন্তব্য যোগ করা যাবে। এতে অন্যরা বুঝতে পারবেন কী ঘটছে। এ ছাড়া যেকোনো অভিযোগের সঙ্গে ছবি ও ভিডিও যুক্ত করা যায় এই সাইটে।’
প্রতিরোধ ডটনেটে কী আছে?
প্রতিরোধ ডটনেটে সহজে ও সঠিকভাবে রিপোর্টিং করা যাচ্ছে। কয়েকটা ক্লিকেই যেকোনো ঘটনা সম্পর্কে জানানো যাচ্ছে। সাইটটির সহ–উদ্যোক্তা মারওয়া কাজী মোহাম্মদ বলেন, ‘আমরা অনেক সমস্যার কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি বনানী থাকি, এখানে অনেকেই আলাদা আলাদা দলে ভাগ হয়ে রাতে ডাকাত প্রতিরোধে দাঁড়িয়ে যান। সবাই আলাদাভাবে কাজ শুরু করেন। আমরা সবাইকে এক করার চেষ্টা করছি এই সাইটের মাধ্যমে। বিক্ষিপ্তভাবে কাজ না করে সবাই যেন এক হয়ে কাজ করেন, তার জন্যই প্রতিরোধ ডটনেট কাজ করছে।’
এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রধানত ছয় ধরনের অপরাধের ঘটনা রিপোর্ট করা যায়। যিনি রিপোর্ট করবেন, তাঁর অবস্থান স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানচিত্রে দেখা যায়। বিভিন্ন এলাকায় ঘটে যাওয়া অপরাধের ঘটনা দেখা যায় সাইটের লাইভ ম্যাপের মাধ্যমে। মারওয়া বলেন, এই প্ল্যাটফর্মের সবচেয়ে বড় চমক হচ্ছে, একসঙ্গে এক জায়গায় সব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও তরুণদের একত্র করা যাচ্ছে। কম সময়ে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করছে। কারিগরিভাবে এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ঘটনা রিপোর্ট করলে সত্যিকারের ঘটনা সম্পর্কে জানা যায়।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ফাহিম মুর্শেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গানাইজেশন স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড লিডারশিপ বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি কো-ডিজাইন নামের একটি প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান টেক লিড হিসেবে কাজ করছেন এখন। মারওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগ থেকে বিবিএ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বর্তমানে একটি মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হিসেবে কাজ করছেন। ওয়েবসাইট চালুর পরে অনেকেই সাইটটি ভবিষ্যতে নানাভাবে ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন। মারওয়া কাজী মোহাম্মদ বলেন, ‘আমাদের সমাজে নিয়মিত অনেক অপরাধই ঘটছে। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিভিন্ন নারীদের প্রতি সহিংসতা, রাস্তায় ছিনতাই, চুরিসহ বিভিন্ন সামাজিক অপরাধ দমনে ভবিষ্যতে কমিউনিটি ও তারুণ্যের সমন্বয় করে সমাধানের পরিকল্পনা আছে আমাদের।’