গ্রামাঞ্চলের ক্ষেত্রে
১। ঘর তৈরির সময় খেয়াল রাখুন যেন তা মাটি থেকে যথাসম্ভব উঁচু স্থানে হয়। মজবুত ভিত্তির ওপর লোহার বা কাঠের পিলার এবং ফ্রেম দিন। অতঃপর তা ছাউনি দিয়ে ঢেকে দিন। ছাউনিতে টিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক হোন, কারণ ঝড়ের সময় টিন উড়ে মানুষ ও গবাদিপশু আহত করতে পারে। এক্ষেত্রে ০.৫ মিলিমিটার পুরুত্ববিশিষ্ট টিন ও জেহুক ব্যবহার করতে পারেন।
২। ঝড়ের কথা মাথায় রেখেই বাড়ির আঙ্গিনায় নারকেল, কলা, বাঁশ, তাল, কড়ইসহ অন্যান্য শক্ত গাছপালা লাগান।
৩। জেলে নৌকা, লঞ্চ ও ট্রলারসহ সকল জলযানগুলোতে রেডিও রাখুন। নদী বা সাগরে থাকার পুরোটা সময় আবহাওয়ার পূর্বাভাস শোনার অভ্যাস করুন।
৪। ঘূর্ণিঝড়ের মৌসুমে বাড়িতে কয়েক দিন মজুত করে রাখা যায় এরকম শুকনো খাবার যেমন মুড়ি, চিড়া, বিস্কুট ইত্যাদি রাখবেন।
৫। ঘূর্ণিঝড়ের সময় কোন এলাকার লোক কোন আশ্রয়ে যাবে, গবাদিপশু কোথায় থাকবে, সবকিছু আগে থেকে ঠিক করে রাখুন। কাছে এবং দূরে যথা সম্ভব সব সুরক্ষিত জায়গাগুলো সবাই আগেই চিনে রাখুন।
৬। সম্ভব হলে সব সময় কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম যেমন ব্যান্ডেজ, ডেটল প্রভৃতি সঙ্গে রাখুন।
৭। আশ্রয়কেন্দ্রে বা অন্য আশ্রয়ে যাওয়ার সময় কী কী জিনিস সঙ্গে নেবেন আর কী কী জিনিস মাটিতে পুঁতে রাখবেন, তা আগে থেকেই ঠিক করে রাখুন। অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী যেমন- চাল, ডাল, দেশলাই, শুকনো কাঠ, পানি ফিটকিরি, চিনি, নিয়মিত ব্যবহৃত ওষুধ, বইপত্র, ব্যান্ডেজ, তুলা, ওরস্যালাইন, দলিলপত্র, টাকা-পয়সা ইত্যাদি পানি নিরোধক পলিথিন ব্যাগে ভরে মাটিতে পুঁতে রেখে যেতে পারেন।
৮। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গেই আপনার ঘরগুলোর অবস্থা একবার পরীক্ষা করে নিন। আরও মজবুত করার জন্য মাটিতে খুঁটি পুঁতে দড়ি দিয়ে ঘরের বিভিন্ন অংশ বেঁধে রাখতে পারেন।
৯। পূর্বাভাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিপিপির (সাইক্লোন প্রিপেয়ার্ডনেস প্রোগ্রাম) স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করুন।
১০। বাড়ি ছাড়ার পূর্বে অবশ্যই চুলা নিভিয়ে যাবেন কিংবা গ্যাসের লাইন ও সিলিন্ডারের চাবি বন্ধ করে যাবেন।
১১। টিউবওয়েলের মাথা খুলে নিন। অতঃপর সেই খোলা অংশ পলিথিন দিয়ে ভালোভাবে আটকে রাখুন যাতে টিউবওয়েলের মধ্যে ময়লা ঢুকতে পারবে না।
১২। বৃষ্টির পানি বিশুদ্ধ ও খাওয়ার উপযোগী। তাই ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রাখুন। মাটির বড় হাঁড়িতে বা ড্রামে পানি রেখে তার মুখ ভালোভাবে আটকিয়ে দিন, যেন পোকা-মাকড় বা ময়লা-আবর্জনা ঢুকতে না পারে।
শহরাঞ্চলের ক্ষেত্রে
১। অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টিভি ও রেডিও তে ঘূর্ণিঝড়ের খবর পেয়ে আতঙ্কিত না হয়ে শান্ত থেকে নির্দেশনা শুনুন এবং সে অনুযায়ী কাজ করুন।
২। আপনার পাওয়ার ব্যাংক, চার্জার লাইট, টর্চ লাইট ফুল চার্জ দিয়ে নিন। মোমবাতি এবং লাইটার সঙ্গে রাখুন।
৩। আপনার বাসা যদি টিন শেড হয় বা আপনি যদি নিচ তলায় থাকেন তাহলে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পানিরোধক বাক্সে টেপ এবং পলিথিন দিয়ে পেঁচিয়ে রাখুন। মেঝেতে অবশ্যই মাল্টিপ্লাগ রাখবেন না।
৪। নিরাপত্তার জন্য শহর জুড়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ফোন নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকতে পারে। রাস্তা বন্ধ থাকতে পারে। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে শুকনো খাবার সংগ্রহে রাখুন।
৫। রেলিংয়ের ওপর ফুলের টব, সানশেডে থাকা এসির বাইরের যন্ত্র, কনস্ট্রাকশন এর জিনিস নিরাপদ স্থানে রাখুন। আপনার বাসার পাশে নির্মাণাধীন ভবন থাকলে আপনাকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
ঘূর্ণিঝড় সময়কালীন সাবধানতা
গ্রামাঞ্চলের ক্ষেত্রে
১। অস্থিরভাবে দৌড়াদৌড়ি না করে যতো দ্রুত সম্ভব কাছাকাছি কোনো সুরক্ষিত স্থানে আশ্রয় নিন।
২। ভাঙা বৈদ্যুতিক খুঁটি, ছিঁড়ে পড়ে থাকা তার ও আশেপাশের জলাবদ্ধতা এড়িয়ে চলুন।
শহরাঞ্চলের ক্ষেত্রে
১। ভারি বর্ষণের দরুণ রাস্তায় জলাবদ্ধতার কারণে অনেক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় এ ব্যাপারে সাবধান থাকুন।
২। প্রচুর বজ্রপাতের কারণে ঘরের বৈদ্যুতিক আসবাব নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই সেগুলোর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখুন। পাশাপাশি গ্যাসের চাবিও বন্ধ করে রাখুন।
৩। দরজা জানালা বন্ধ রাখুন যেন বাইরে থেকে ময়লা বা ভারি কোনো কিছু উড়ে এসে আঘাত করতে না পারে।
৪। মোবাইল ফোনে কথা বলে নেটওয়ার্ক ব্যস্ত না রেখে সরাসরি এসএমএস ব্যবহার করে পরস্পরের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করুন।
৫। মোবাইল ফোনে ডেটা কানেকশন চালু রেখে কোনো অ্যাপ চালানো থেকে বিরত থাকুন। কেননা, এতে ব্যাটারি দ্রুত শেষ হয়। খবর শুনতে হলে ফোনে বিল্ট-ইন রেডিওতে শুনতে পারেন।
৬। রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন। এছাড়াও ঝড় বাতাসে উপড়ে যাওয়া গাছ এবং বাতাসে উড়ে আসতে পারে এমন যে কোনো বস্তুর ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করুন। তবে এ সময় নিজ নিজ নিরাপদ বাসস্থানে থাকাই উত্তম।
৭। রাস্তায় হঠাৎ ঝড়ের কবলে পড়ে গেলে শপিংমল, মসজিদ, স্কুল বা যেকোনো দালানে এ আশ্রয় নিন।
ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী করণীয়
গ্রামাঞ্চলের ক্ষেত্রে
১। যারা শক্ত-সমর্থ আছেন তারা সবাই একত্রিত হয়ে রাস্তাঘাটের ওপর উপড়ে পড়া গাছপালা সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করুন। এতে সাহায্যকারী দল সহজে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারবে।
২। নিজের শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী বিপর্যস্ত মানুষকে বাড়ি ফিরতে সাহায্য করুন। সম্ভব হলে নিজের গ্রামে অন্যদের থাকার সুযোগ করে দিন। এনজিও বা সরকারি সাহায্যের অপেক্ষায় বসে থাকবেন না।
৩। অতিদ্রুত উদ্ধার দল নিয়ে বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়া লোকদের উদ্ধার করুন।
৪। কোনো অবস্থাতেই ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িতে প্রবেশ করবেন না। ভাঙা বাড়ি মেরামতের ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকবেন।
৫। ভেঙে পড়ে থাকা বৈদ্যুতিক খুঁটি, ছেড়া তার এবং তৎসংলগ্ন জলাবদ্ধতা এড়িয়ে চলুন।
৬। নারী, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী ও অসুস্থ লোকদের নিকট ত্রাণ ঠিকমতো পৌছাচ্ছে কি-না সেটা নিশ্চিত করুন।
৭। পুকুরের বা নদীর পানি সরাসরি না খেয়ে ফুটিয়ে পান করুন। বৃষ্টির জমানো পানি পান করুন।
৮। কম সময়ে উৎপাদনশীল ধান ও শাক-সবজির জন্য জমি প্রস্তুত করুন, বীজ সংগ্রহ করুন। অতঃপর চাষাবাদ শুরু করুন, যেন যথাসম্ভব দ্রুত ফসল ঘরে আসে।
শহরাঞ্চলের ক্ষেত্রে
১। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর মতো এখানেও কোনো অবস্থাতেই ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির ভেতর ঢুকবেন না। পর্যাপ্ত সতর্কতা অবলম্বন করে ভাঙা বাড়ি মেরামতের ব্যবস্থা করবেন।
২। গ্রামের তুলনায় শহরে বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তারের পরিমাণ বেশি। তাই ঝড়ের পরে বিভিন্ন স্থানে ভেঙে যাওয়া বৈদ্যুতিক খুঁটি, ছেঁড়া তার পড়ে থাকতে পারে। এগুলোর ব্যাপারে সাবধানে থাকবেন।
ঘূর্ণিঝড়ের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার পরেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশেষ করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতিগুলো সেই অর্থে পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হয়ে উঠে না। এজন্য সরকারি কর্মসূচীগুলোর পাশাপাশি শহরের সচ্ছল মহলগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধুমাত্র ত্রাণ বিতরণের পরিবর্তে বিপর্যস্ত মানুষগুলোর জন্য পুনর্বাসন এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হলে ক্ষতিগ্রস্তদের ঘূর্ণিঝড়ের পরে একদম শূন্য থেকে শুরু করতে হবে না।