নিজের কাজের জন্য একটি ল্যাপটপ কম্পিউটার কিনতে আইরিন আক্তারের লেগেছিল প্রায় এক বছর। সেই আইরিন এখন প্রতি মাসে আয় করেন প্রায় এক হাজার ডলার, বাংলাদেশি টাকায় প্রায় এক লাখ ২০ হাজার টাকা। আইরিন আক্তার মুক্ত পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তির কাজ করেন।
নেত্রকোনার বারহাট্টা ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০১২ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর আইরিন চলে আসেন গাজীপুরে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ থেকে বাংলায় ২০১৮ সালে স্নাতক ও ২০২০ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর আইরিন কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরি পান গাজীপুরের শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজি স্পেশালাইজড হসপিটাল অ্যান্ড নার্সিং কলেজে।
চাকরির ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু সময় পেতেন, ফেসবুকেই সময় কাটাতেন। একদিন ফেসবুকেই ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে জানতে পারেন আইরিন। তিনি ফেসবুকে অনেক মানুষের ছবি ও ভিডিও দেখেন, যাঁরা মুক্ত পেশাজীবী হিসেবে সফল হয়েছেন। এটা তাঁকে প্রভাবিত করে। সিদ্ধান্ত নেন চাকরির বাইরে যতটুকু সময় পাবেন, তিনি কোনো একটা বিষয় শিখে দক্ষ হয়ে ফ্রিল্যান্সিং করবেন।
ডিজিটাল বিপণন বিষয়টি ভালো লাগে আইরিনের। অবসর পেলে অনলাইনে এ বিষয়ের ভিডিও দেখতে থাকেন আইরিন। মুক্ত পেশাজীবী হতে চাওয়ার আরেকটা কারণ ছিল ছোটবেলা থেকেই স্মার্টফোন ও কম্পিউটারের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি। ফোনে ডিজিটাল বিপণনের নানা ভিডিও দেখতে দেখতে তিনি বুঝতে পারেন, ল্যাপটপ বা কম্পিউটার ছাড়া এ কাজ শেখা যাবে না। আইরিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘তখনই সিদ্ধান্ত নিই, বেতনের টাকা জমিয়ে ল্যাপটপ কম্পিউটার কিনব। পরিবারকে চাপ দিতে চাইনি।’
আইরিন বলেন, ‘বাংলায় যেহেতু পড়েছি, ইচ্ছা ছিল কোনো কলেজ অথবা স্কুলে শিক্ষকতা করার। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সেই চাকরি পাইনি। চাকরির জন্য কত সিভি জমা দিয়েছি, তার কোনো হিসাব নেই। অবশেষে অনেক চেষ্টার পর গাজীপুরের শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজি স্পেশালাইজড হসপিটাল অ্যান্ড নার্সিং কলেজে কম্পিউটার অপারেটরের চাকরি শুরু করি মাসিক ১৫ হাজার টাকা বেতনে।’ সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অফিস করতে হয় তাঁকে। এই চাকরি এখনো করেন আইরিন।
আইরিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘টানা এক বছর কষ্ট করে চলে ৩০ হাজার টাকা জমালাম। প্রতি মাসে আমি আমার মা ও ভাইকে কিছু টাকা দিতাম। মাকে যখন একটা ল্যাপটপ কেনার কথা বললাম, তখন মা তাঁর সেই জমানো টাকা থেকে আমাকে দিল আরও ১২ হাজার। সব মিলিয়ে ৪২ হাজার টাকা দিয়ে একটা পুরোনো ল্যাপটপ কিনলাম। শুরু হলো আমার ফ্রিল্যান্সিং যাত্রা।’ নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা থানার যশমাধব গ্রামে আইরিন আক্তারের বাড়ি। তাঁর বাবার নাম মো. ছদ্দু মিয়া। তিনি একজন কৃষক। মা সুফিয়া খাতুন গৃহিণী। দুই ভাইবোনের মধ্যে আইরিন ছোট। তাঁর বাবা একজন কৃষক। যক্ষ্মায় আক্রান্ত বাবা প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন, তেমন কাজ করতে পারতেন না।
আইরিন অনলাইন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে স্কিলআপার সম্পর্ক জানতে পারেন, সেখানে কোর্স করার সিদ্ধান্ত নেন। এর আগেও একটা প্রশিক্ষণ কোর্স করেছিলেন তিনি। সেখানে ডিজিটাল বিপণন সম্পর্কে সাধারণ ধারণা পান তিনি। কিন্তু স্কিলআপারের কোর্সটা ছিল উচ্চ স্তরের। অন্যদের তুলনায় আইরিনের শেখার বিষয়টা ছিল আলাদা। চাকরির কারণে দিনে একদমই সময় পেতেন না। তাই সপ্তাহে দুই দিন ক্লাস করতেন এবং সারা সপ্তাহ রাত জেগে সেগুলোর চর্চা করতেন।
আইরিন বলেন, ‘টানা এক বছর ঘুম যে কী, তা ভুলতেই বসেছিলাম। সন্ধ্যার পর যতটুকু সময় পেতাম একটু ঘুমিয়ে নিতাম, রাত ৯টায় এলার্ম দিয়ে রাখতাম ঘুম থেকে ওঠার জন্য। সন্ধ্যা থেকে রাত ৯টা, টানা এক বছর এটাই ছিল আমার ঘুমের রুটিন। রাত ৯টা থেকে ভোর ৪-৫টা পর্যন্ত ডিজিটাল বিপণনের নানা বিষয় চর্চা করতাম।’
টানা এক বছর পরিশ্রম করার পর সফলতার মুখ দেখেছেন আইরিন। তাঁর প্রথম কাজটি ছিল গুগল অ্যাডসের, বাংলাদেশি মুদ্রায় টাকার পরিমাণ ছিল ২৯ হাজার। এটি ২০২০ সালের কথা। বর্তমানে তাঁর মাসিক আয় এক হাজার ডলারের বেশি।