ত্রিমাত্রিক প্রিন্টিংয়ের বিশ্বজয়
থ্রি–ডি প্রিন্টারের বিশেষত্ব হলো, এটা দিয়ে আক্ষরিক অর্থে যেকোনো আকার-আকৃতির বস্তু তৈরি করা সম্ভব। সে জন্য লাগবে একটা ডিজিটাল ফাইল, যেটা আপনি কম্পিউটার সহায়ক ডিজাইন সফটওয়্যার (computer aided design software–CAD), যেমন অটোক্যাড (AutoCaD), সলিড ওয়ার্কস (SolidWorks) ইত্যাদির মাধ্যমে তৈরি করতে পারবেন। অথবা রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং তথা থ্রি–ডি স্ক্যান, সিটি স্ক্যান বা এমআরআইয়ের মাধ্যমেও আপনি ডিজিটাল ফাইলটা পেতে পারেন। এরপর থ্রি–ডি প্রিন্টার ওই ডিজিটাল ফাইলের তথ্যগুলো ব্যবহার করে, স্তরে স্তরে কঠিন উপাদান যোগ করে সেটার মতো হুবহু একটা বস্তু বানিয়ে ফেলতে পারে।
অনেকের মতে, ১৯৮১ সালে জাপানি বিজ্ঞানী হিদিও কোদামা প্রথম থ্রি–ডি প্রিন্টিংয়ের ধারণাটা দেন। তিনি অতিবেগুনি রশ্মি প্রয়োগ করে তরল পলিমার শক্ত করে একটা বস্তু বানান। অবশ্য বিভিন্ন গবেষণাপত্রে চার্লস হলের নামটাই থ্রি–ডি প্রিন্টিংয়ের উদ্ভাবক হিসেবে বেশি আসে। তিনি ১৯৮৫ সালে একই পদ্ধতিতে অতিবেগুনি রশ্মি ব্যবহার করে বিভিন্ন বস্তুর প্রতিরূপ তৈরি করেন, যা কিনা স্টেরিওলিথোগ্রাফি থ্রি–ডি প্রিন্টিং নামে পরিচিত। তিনি তাঁর উদ্ভাবিত পদ্ধতিটা পেটেন্টও করেন। পরে পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত থ্রি–ডি প্রিন্টার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান থ্রি–ডি সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করেন তিনিই। স্টেরিওলিথোগ্রাফি ছাড়াও ছয় ধরনের থ্রি–ডি প্রিন্টিং পদ্ধতি আছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন সব জটিল বস্তু বানানো সম্ভব, যা অন্যান্য প্রস্তুত প্রণালিতে চিন্তাও করা যায় না। প্রথম দিকে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে শুধু প্রতিরূপ বা প্রোটোটাইপ তৈরি করা হতো। কিন্তু প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ও উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ, অলংকার, খাদ্যদ্রব্য, জুতার সোল ইত্যাদি জিনিস বানানো হয়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেইনের থ্রি–ডি প্রিন্টার ব্যবহার করে ৭ দশমিক ৬২ মিটার লম্বা এবং ২ দশমিক ২ টন ওজনের একটা নৌকা তৈরি করেছেন। সেটা গিনেস বুকে এই প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি করা সবচেয়ে বড় নৌকা হিসেবে স্থান পেয়েছে।
থ্রি–ডি প্রিন্টিং থেকে থ্রি–ডি বায়োপ্রিন্টিং
লেখার প্রথম দিকে যে অবিশ্বাস্য একটা সম্ভাবনার কথা বলেছিলাম, সেটা নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যাক। ১৯৫৪ সালে প্রথম দুজন যমজের মধ্যে সফলভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হলে এই অঙ্গ প্রতিস্থাপন মানুষের জীবন বাঁচানোর একটা আশাজাগানিয়া পদ্ধতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এক পরিসংখ্যান বলছে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতিদিন ৭৯ জনের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপিত হয়। এরপরও প্রশ্ন জাগে, তাহলে কেন মানুষ এই কিডনি, লিভার, হার্টসহ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উৎপাদনের চেষ্টা করছে? এর সবচেয়ে বড় কারণ হলো, রোগীর তুলনায় অঙ্গদাতার সংখ্যা অনেক কম। ২০২০ সালের মার্চের সর্বশেষ সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রে যে পরিমাণ মানুষ অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষা করছে, তার ৮৩ দশমিক ১ শতাংশ অপেক্ষা করছে কিডনির জন্য, ১০ দশমিক ৪ শতাংশ লিভারের জন্য, ৩ শতাংশ হার্টের জন্য এবং ১ দশমিক ১ শতাংশ অপেক্ষা করছে ফুসফুসের জন্য। যথাসময়ে উপযুক্ত অঙ্গ না পেয়ে প্রতিদিন ২০ জনের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। আর আহত বা নষ্ট অঙ্গ অন্য মানুষের ভালো অঙ্গ দ্বারা প্রতিস্থাপনই শেষ কথা নয়, বিভিন্ন সংক্রমণের কারণে এই পুরো প্রক্রিয়া সফল না–ও হতে পারে। এর অনেক উদাহরণ আমাদের সামনেই আছে। এরই দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে রোগীর নিজস্ব কোষ ব্যবহার করে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরির বা বায়ো-ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের চেষ্টা মানুষ অনেক দিন ধরেই করে আসছে, যাকে কিনা টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিংও বলা হয়। এ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটি সাধারণ কৌশল হলো, উপযুক্ত বায়োম্যাটেরিয়াল দিয়ে প্রথমে নির্দিষ্ট আকার ও আকৃতির একটি সচ্ছিদ্র কাঠামো বানানো হয় এবং তাতে জীবিত কোষ সংযুক্ত করা হয়। কাঠামোটা সচ্ছিদ্র হওয়া জরুরি, যা কিনা কোষের খাদ্য (growth media) ও প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ, কোষের বিভাজন ও বিস্তার এবং পরিশেষে টিস্যু পুনর্জন্মে সহায়তা করে। তাহলে ভাবুন, উপযুক্ত বায়োম্যাটেরিয়াল দিয়ে কোনো রোগীর কিডনির আকার ও আকৃতির মতো করে একটি কাঠামো তৈরি করা হলো। এরপর সেই কাঠামোতে ওই রোগীরই স্টেম কোষ সংযুক্ত করা হলো। এখন যদি কোষের প্রয়োজনীয় খাবার ও গ্যাস সরবরাহ করা হয়, তাহলে কোষের বিভাজন ও বিস্তারের মাধ্যমে একসময় একটি কিডনি তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা। সত্যি কথা বলতে, মূল ধারণা এটা হলেও এর সফলতা নির্ভর করে অনেকগুলো উপাদানের সমন্বয়ের ওপর।
গবেষকেরা মনে করেন, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বানানোর কাজটি সফল করতে হলে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার থ্রি–ডি প্রিন্টিং প্রযুক্তি, জীববিজ্ঞান, বায়োম্যাটেরিয়াল, রসায়ন, কম্পিউটার বিজ্ঞানের অনেক ভূমিকা আছে। ঠিক এই কারণেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে (যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারত) টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে কাজ করা গবেষক দল তৈরি হয়েছে। সেই দলে আছে ইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসক, উপাদানবিজ্ঞানী, রসায়নবিদ ও কম্পিউটার বিজ্ঞানীদের সমন্বয়।
আগেই বলেছি, থ্রি–ডি প্রিন্টিংয়ের সাহায্যে যেকোনো জটিল বস্তু হুবহু বানানো সম্ভব। তাই গবেষকেরা অন্তত দুই দশক ধরেই থ্রি–ডি প্রিন্টিংয়ের সাহায্যে নানা রকম টিস্যুর প্রতিরূপ বানানোর চেষ্টা করে আসছেন। থ্রি–ডি প্রিন্টিং প্রযুক্তির সাহায্যে জৈব–কালির (Bio-ink) মাধ্যমে জীবিত টিস্যু তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে, তাই টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যবহৃত এই প্রযুক্তিকে বলা হয় থ্রি–ডি বায়োপ্রিন্টিং। জৈব–কালি সাধারণত বায়োম্যাটেরিয়াল, প্রয়োজনীয় প্রোটিন, ওষুধ কণা, কোষ বিভাজন ও বিস্তার সহায়ক জৈবিক উপাদান এবং জীবন্ত কোষের মিশ্রণে তৈরি হয়। আশা করছি, আমি থ্রি–ডি প্রিন্টিং ও থ্রি–ডি বায়োপ্রিন্টিংয়ের পার্থক্য বোঝাতে পেরেছি।
পৃথিবীব্যাপী টিস্যু পুনর্জন্মের নানা চেষ্টা
টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে থ্রি–ডি বায়োপ্রিন্টিং প্রযুক্তি ব্যবহারের অন্যতম কারণ হলো, এর সাহায্যে দ্রুত কোনো রোগীর প্রয়োজনীয় অঙ্গের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ আকার–আকৃতি, যান্ত্রিক ও গঠনগত বৈশিষ্ট্য অবিকলভাবে তৈরি করা সম্ভব। এই বৈশিষ্ট্যগুলো নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এই বিষয়গুলো ওই রোগীর শরীরে ওষুধ ও অন্যান্য প্রোটিন প্রয়োগে, কোষ বিভাজন ও বিস্তারে এবং পরিশেষে একটি পূর্ণাঙ্গ অঙ্গ তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রাখে। সারা পৃথিবীই টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে থ্রি–ডি বায়োপ্রিন্টিংয়ের সম্ভাবনা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখছে। এ কারণেই ধারণা করা হচ্ছে, এই প্রযুক্তির বাজারমূল্য ২০১৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল নাগাদ ৬৫১ মিলিয়ন ডলার থেকে ১ হাজার ৬৪৭ মিলিয়ন ডলারে ঠেকবে। পৃথিবীব্যাপী গবেষকেরা বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বানানোর যে চেষ্টা করছেন, তারই কিছু নমুনা এই ছবিতে দেখানো হলো
প্রতিবন্ধকতা ও আশার বাণী
সফলভাবে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরির এ প্রক্রিয়া এতটা সহজ হবে না। অনেকগুলো উপাদানের সম্মিলিত প্রয়োগেই এটা সম্ভব। আশার বিষয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ একক ও সম্মিলিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে এতে সাফল্য পাওয়ার জন্য। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, ১৫-২০ বছরের ভেতর আমরা বড় সাফল্য পাব। সেদিন হয়তো কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রোগী তার একটা অঙ্গ পরীক্ষাগার থেকে তৈরি অবস্থায় পাবে। আশা করা, স্বপ্ন দেখা ও সে অনুসারে কাজ করার মধ্যে তো কোনো ক্ষতি নেই। আমি নিজেও ২০১৫ সাল থেকে থ্রি–ডি বায়োপ্রিন্টিংয়ের ওপর গবেষণা করে যাচ্ছি। সম্প্রতি এ বিষয়ে পিএইচডি অর্জনের পর সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারে অবস্থিত কিন স্টেট কলেজে। সেখানে টেকনোলজি, ডিজাইন ও সেফটি সেন্টারে (TDS Center) থ্রি–ডি বায়োপ্রিন্টিং–সংক্রান্ত গবেষণাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি এবিএম ল্যাব নামের একটি পরীক্ষাগার। আমার জানামতে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসরত অনেক বাঙালি গবেষক টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর গবেষণা করছেন। বাংলাদেশে এ গবেষণা এখনো তেমনভাবে শুরু হয়নি। সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয়, যখন আমাদের দেশেও এটা শুরু হবে। বাংলাদেশে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পুনর্জন্মসংক্রান্ত গবেষণায় আমরা যদি কিছুটা হলেও অবদান রাখতে পারি, সেটা আমাদের জন্য আনন্দের ব্যাপার হবে। এই সহযোগিতা করার জন্য আমরা সব সময় প্রস্তুত।