উড়োজাহাজের ব্ল্যাকবক্স

১৯৫০-এর দশক। যুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবী সবে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য আকাশ জুড়ে চলাচল করছে বিভিন্ন দেশের উড়োজাহাজ। যুক্তরাজ্যের বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ বহরে যুক্ত হয়েছে প্রথম কোনো জেট ইঞ্জিন চালিত উড়োজাহাজ।

যুক্তরাজ্যের উড়োজাহাজ নির্মাতা কোম্পানি ডি হাভিল্যান্ডের তৈরি কমেট ১ নামের সেই উড়োজাহাজটি আকাশ পথে যোগাযোগের নতুন দ্বার উন্মোচন করেছিল। প্রবল গতির কারণে ভ্রমণের সময় নেমে এসেছিল অর্ধেকের কাছাকাছি।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সালের মধ্যে কমেট ১-সহ এই সিরিজের অন্যান্য উড়োজাহাজগুলো মোট সাতবার দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। মারা যান প্রায় ১১০ জন মানুষ।

কর্তাব্যক্তিরা দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে নেমে পড়েন। কিন্তু ঠিক কী কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে, তা জানা যাচ্ছিল না। ১৯৫৪ সালে কমেট সিরিজের সবগুলো উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেয় ব্রিটিশ সরকার। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের জন্য ব্যপক আকারে শুরু হয় তদন্ত। অনেক গবেষণার পর দেখা যায়, উড়োজাহাজের বর্গাকার জানলায় থাকা ধাতব অংশের জড়তাই মূলত দুর্ঘটনাগুলোর পেছনে দায়ী ছিল।

আরও পড়ুনউড়োজাহাজের ওপর বজ্রপাত হলে কী ঘটে?

ফ্লাইট রেকর্ডার যন্ত্র  বা ব্ল্যাকবক্স
ফ্লাইট রেকর্ডার যন্ত্র বা ব্ল্যাকবক্স

সেই সময় পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে অস্ট্রেলিয়ার সিভিল এভিয়েশন ডিপার্টমেন্টে উড়োজাহাজ বিশেষজ্ঞরাও দুর্ঘটনার কারণ জানতে কাজ করছিলেন। এই বিশেষজ্ঞ দলে ছিলেন ২৮ বছর বয়সী ড. ডেভিড ওয়ারেন। কিছুদিন আগেই ভদ্রলোক অষ্ট্রেলিয়া সরকার পরিচালিত অ্যারোনটিক্যাল রিসার্চ ল্যাবে রসায়নবিদ হিসেবে যোগ দিয়েছেন। কাজ করছেন উড়োজাহাজের জ্বালানী নিয়ে।

দুর্ঘটনার কারণ বের করার জন্য তাঁরা যে তথ্য নিয়ে কাজ করছিলেন, তার পরিমাণ ছিল খুবই সামান্য। ওয়ারেনের মনে হলো, তথ্যের পরিমাণ বেশি হলে দুর্ঘটনার কারণ বের করা যেমন সহজ হতো, তেমনি সেই কারণগুলো প্রতিরোধও করা যেত ভালোভাবে। পরবর্তীতে একই কারণে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কমে যেত।

কিছুদিন আগেই এক মেলায় ওয়ারেন জার্মান উদ্ভাবকের তৈরি ডিক্টোফোন দেখেছিলেন। ইস্পাতের তারের সাহায্যে শব্দ রেকর্ড করতে পারে সেটা। মাথায় খেলে গেল এক চিন্তা। কোনোভাবে এই যন্ত্রকে কি উড়োজাহাজে বসানো যায়? তথ্য সংগ্রহ করবে উড়োজাহাজের।

সে সময় যে উড়োজাহাজে তথ্য রেকর্ড করার কোনো যন্ত্র ছিল না, তা নয়। সামরিক কিছু উড়োজাহাজের তথ্য সংগ্রহের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে কিছু যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছিল। তবে সেগুলো শুধু উড়োজাহাজের যান্ত্রিক বিষয়গুলোর রেকর্ড রাখত। বৈমানিকদের কথা বা উড়োজাহাজের ভেতরের শব্দ রেকর্ড করার যন্ত্র একেবারেই ছিল না কোথাও।

যাই হোক, এক মিটিংয়ে ওয়ারেন কিছু চিরকুটে তার আইডিয়াগুলো লিখে জানান উর্ধ্বতন কমকর্তাকে। বলেন, অ্যারোনটিক্যাল রিসার্চ ল্যাব যদি এমন একটি ভয়েস রেকর্ডার তৈরি করে উড়োজাহাজে স্থাপন করতে পারে, তাহলে ক্র্যাশের আগ মুহূর্তে পাইলট কোন পরিস্থিতিতে ক্র্যাশ ল্যাণ্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা জানা যাবে। এই রেকর্ডারের পাশাপাশি, উড়োজাহাজের যান্ত্রিক তথ্য রেকর্ডের যন্ত্রও থাকতে হবে উড়োজাহাজে। আর এই দুটো যন্ত্রই এমনভাবে উড়োজাহাজে রাখতে হবে, যেন উড়োজাহাজ ধ্বংস হলেও যন্ত্রে ধারণকৃত তথ্যগুলো অক্ষত থাকে।

পাশাপাশি তিনি এটাও জানান যে উড়োজাহাজের গতি এবং উঁচুতে ওড়ার ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুর্ঘটনার পরিমাণও হয়ত বেড়ে যাবে। এসব দুর্ঘটনা রোধ করতে তথ্যের বিকল্প নেই। তাই এ পরিকল্পনা যতো দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা উচিত।

ব্ল্যাকবক্সের প্রোটোটাইপের হাতে ডেভিড ওয়ার্নার
ব্ল্যাকবক্সের প্রোটোটাইপের হাতে ডেভিড ওয়ার্নার

ওয়ারেনের সেই প্রস্তাব যে উর্ধ্বতন কর্মতারা লুফে নিয়েছিলেন, ব্যাপারটা তেমন নয়। তবে যন্ত্রটি তৈরির কাজের অনুমোদন দিয়েছিলেন তাঁরা। তবে নানা সরকারি নিয়ম-কানুনের বেড়াজালে ল্যাবে যন্ত্রটি তৈরির কাজে খুব একটা অগ্রগতি হচ্ছিল না।

ওয়ারেন নিজেই তাই সপ্তাহান্তে গ্যারেজে বসে যন্ত্রটি তৈরির কাজ করতেন। একটা সময় প্রোটোটাইপও তৈরি করে ফেলেন।

১৯৫৭ সালে ওয়ারেনের উর্ধ্বতন কমর্কতার দায়িত্বে আসেন টম কিবোল। ভদ্রলোক ওয়ারেনকে বেশ উৎসাহ দেন। পরামর্শ দেন, এ নিয়ে গবেষণাপত্র লিখে অস্ট্রেলিয়ার উড়োযান কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে। যন্ত্রটির আরও উন্নত প্রোটোটাইপ তৈরির জন্য কিবোল ৬০০ পাউন্ড অর্থও দেন ওয়ারেনকে।

ওয়ারেন আরও খাটাখাটনি করে যে যন্ত্রটি দাঁড় করালেন, সেটা ককপিটের চার ঘন্টার শব্দ রেকর্ড করতে পারত। ইস্পাতের তারের সাহায্যে প্রতি সেকেণ্ডে চারবার করে রেকর্ড করা যাচ্ছিল উড়োজাহাজের ৮টি যন্ত্রের রিডিং। যন্ত্রটি উড়োজাহাজের ইঞ্জিনের সঙ্গে চালু হতো, বন্ধও হতো ইঞ্জিনের সঙ্গে। এতে ধারণকৃত পুরোনো তথ্যগুলো মুছে যেত স্বয়ংক্রিয়ভাবে।

ওয়ারেন তাঁর গবেষণাপত্রে এই ফ্লাইট রেকর্ডার যন্ত্রটি সম্পর্কে বিস্তারিত লেখেন। তিনি প্রস্তাব করেন, সব উড়োজাহাজে যন্ত্রটি স্থাপনের জন্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর এই পেপার খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

১৯৫৮ সালে বৃটিশ এয়ার রেজিস্ট্রেশন বোর্ডের সভাপতি স্যার রবার্ট হার্ডিংহাম অস্ট্রেলিয়ার অ্যারোনটিকস রিসার্চ ল্যাব পরিদর্শনে আসেন। তখন ওয়ারেন ফ্লাইট রেকর্ডার যন্ত্রটি তাঁকে দেখান। বাণিজ্যিকভাবে উড়োজাহাজে ব্ল্যাকবক্স ব্যবহারের সূচনা হয় মূলত সেদিনই।

হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। ভয়েস রেকর্ডার ও ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডারের সংমিশ্রণে তৈরি ওয়ারেনের এই যন্ত্রটিই বর্তমানে উড়োজাহাজের ব্ল্যাকবক্স নামে পরিচিত।

আরও পড়ুনপৃথিবীর সবচেয়ে গভীর গর্ত

সমুদ্রের তলদেশে তলিয়ে গিয়েও টিকে থাকতে পারে ব্ল্যাকবক্স
সমুদ্রের তলদেশে তলিয়ে গিয়েও টিকে থাকতে পারে ব্ল্যাকবক্স

বর্তমানে এর ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার বা FDR অংশে প্রায় ৮৮টিরও বেশি ধরনের যন্ত্রের তথ্য রেকর্ড করা হয়। এর মধ্যে উড়োজাহাজের গতি, গতিপথের দিক, ওড়ার উচ্চতা, জ্বালানি, গতি, টার্বুলেন্স, কেবিনের তাপমাত্রা ইত্যাদি অন্যতম

শুরুতে ব্রিটিশ বেসামরিক উড়োজাহাজে এই ব্ল্যাকবক্স বসানো বাধ্যতামূলক করা হয়। পরে প্রথম দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া সব ধরনের উড়োজাহাজে ব্ল্যাকবক্স স্থাপন করা বাধ্যতামূলক করে। বর্তমানে পৃথিবীর সব উড়োজাহাজে বাধ্যতামূলকভাবে ব্ল্যাকবক্স রাখতে হয়।

একটি উড়োজাহাজে সাধারণত দুটি ব্ল্যাকবক্স থাকে। একটি সামনে, আরেকটি উড়োজাহাজের লেজে। টাইটেনিয়াম দিয়ে তৈরি করা হয় ব্ল্যাকবক্স। পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী ধাতব পদার্থের মধ্যে টাইটেনিয়াম একটি। ফলে উঁচু থেকে শক্ত পাথরের ওপর পড়ে, আগুনে পুড়ে কিংবা সমুদ্রের তলদেশে তলিয়ে গিয়েও টিকে থাকতে পারে ব্ল্যাকবক্স।

বর্তমানে এর ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার বা FDR অংশে প্রায় ৮৮টিরও বেশি ধরনের যন্ত্রের তথ্য রেকর্ড করা হয়। এর মধ্যে উড়োজাহাজের গতি, গতিপথের দিক, ওড়ার উচ্চতা, জ্বালানি, গতি, টার্বুলেন্স, কেবিনের তাপমাত্রা ইত্যাদি অন্যতম। হার্ডডিস্কের মতো চৌম্বকীয় ধাতব পাতে এসব তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তথ্য ধারণ ক্ষমতা বেড়ে এখন সর্বোচ্চ ২৫ ঘন্টা তথ্য ধারণ করা যায় ব্ল্যাকবক্সে। আকাশে থাকার সময় ২৫ ঘন্টার বেশি হলে, আগের তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুছে যায় ব্ল্যাকবক্সের মেমরি থেকে। এ ছাড়া প্রতিটি ফ্লাইট শেষে ব্ল্যাকবক্সের পুরো স্মৃতি মুছে ফেলা হয়।

ব্ল্যাকবক্স ১১ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় প্রায় ১ ঘন্টা এবং ২৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় প্রায় ১০ ঘন্টা টিকতে পারে।

দুর্ঘটনায় পড়ার পর ব্ল্যাকবক্স ৩০ দিন পর্যন্ত শব্দ তরঙ্গ ছড়াতে থাকে। এই শব্দ ২-৩ কিলোমিটার দূর থেকে শনাক্ত করতে পারেন দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞরা। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ব্ল্যাকবক্স সাগরের ১৪ হাজার ফুট নিচে থেকেও শব্দ পাঠাতে পারে।

নামে ব্ল্যাকবক্স হলে কী হবে, যন্ত্রটার বাইরের দিকটা কমলা, লাল বা গোলাপি রঙের হয়। দূর থেকে যেন সহজে চোখে পড়ে, এজন্য এ ধরনের রঙ করা হয়।

তাহলে নামটা ব্ল্যাকবক্স হলো কেন? এ নিয়ে শক্ত কোনো তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় না। অনেকের মতে, এর ভেতরের অংশটি অন্ধকার হয় বলে এমন নামকরণ। প্রায় দুর্ভেদ্য হওয়ার কারণে এই প্রতিকী নাম এসেছে বলেও অনেকে মনে করেন। আবার কেউ কেউ বলেন, আগে যন্ত্রটি বিমানের সম্পূর্ণ অন্ধকার একটি অংশে বসানো হতো বলেই এমন নাম। যাই হোক, ব্ল্যাকবক্স নামটি শুধু মানুষের মুখে মুখেই প্রচলিত। খাতাকলমে যন্ত্রটির নাম, ফ্লাইট রেকর্ডার।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ

সূত্র: ন্যাশনাল মিউজিয়াম অস্ট্রেলিয়া, দ্য কনভারসেশন, উইকিপিডিয়া

At HAMKO Future Tech Academy We are dedicated to shaping the future of technology by equipping students with the skills and knowledge needed to excel in the dynamic world of industrial attachment and freelancing programsHAMKO Future Tech Academy

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here