কাতার বিশ্বকাপের নানা প্রযুক্তি

চলতি বছর কাতারে বসেছিল ফুটবলের মহারণ—বিশ্বকাপ ফুটবল ২০২২। এই বিশ্বকাপকে বলা হচ্ছে প্রযুক্তির বিশ্বকাপ। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় রেফারিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরও দ্রুততর, আরও নির্ভুল। এই বিশ্বকাপের প্রায় সব ভেন্যু ছিল শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। মরুর মাঝে এক টুকরা সবুজের সমারোহ। উন্নত গোললাইন প্রযুক্তি, অর্ধস্বয়ংক্রিয় অফসাইড প্রযুক্তি থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায়, এমন মাঠসহ রয়েছে আরও অনেক কিছু…

কাতার বিশ্বকাপে ট্রফি
কাতার বিশ্বকাপে ট্রফি

বলের প্রযুক্তির সাহায্যে প্রতি সেকেন্ডে ৫০০ বার পর্যন্ত কিক পয়েন্ট ও অবস্থান রেকর্ড করা যায়।

স্পেনের বিপক্ষে জার্মানির খেলার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। জার্মানির জন্য বাঁচা–মরার ম্যাচ। পরের পর্বে খেলতে চাইলে জেতা বাধ্যতামূলক। খেলার ৪০ মিনিটের মাথায় জার্মান ডিফেন্ডার অ্যান্টনিও রুডিগার দুর্দান্ত এক গোল করে উল্লাস করতে থাকেন। তিনি হয়তো ঘুণাক্ষরে কল্পনা করেননি যে এই গোল বাতিল হতে পারে। কিন্তু রুডিগার টের পাওয়া না পাওয়ায় কী আসে–যায়? অফসাইডের দায়ে রেফারি বাতিল করে দেন গোল। শেষ পর্যন্ত বাঁচা–মরার ম্যাচে জার্মানি ১-১ গোলে ড্র করে স্পেনের বিপক্ষে।

লুসাইল স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনা ও সৌদি আরবের ম্যাচটির কথাই ভাবুন। তিন–তিনটি গোল অফসাইডের কারণে বাতিল হয়ে গেল। আর্জেন্টিনা হেরে যায় ২-১ গোলে। ম্যাচটিতে আর্জেন্টিনা ৪-২ গোলে জিততে পারত। পারল না কেন? ওই অপয়া অফসাইড। জার্মানির কথা বলুন আর আর্জেন্টিনা, দুই দলের কপাল পুড়েছে কাতার বিশ্বকাপের আধুনিক প্রযুক্তির কারণে। ফুটবলে এত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার না করলে রেফারি হয়তো এসব সূক্ষ্ম অফসাইড ধরতে পারতেন না। কিন্তু প্রযুক্তিকে তো আর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। কাতার বিশ্বকাপের সেসব অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে এই আলোচনা।

সেমি-অটোমেটেড অফসাইড প্রযুক্তি

প্রথমে বলা যাক ওপরের দুটি ঘটনার জন্য দায়ী সেমি-অটোমেটেড বা অর্ধস্বয়ংক্রিয় অফসাইড প্রযুক্তির কথা। এ বছর কাতার বিশ্বকাপে এই প্রযুক্তি প্রথমবার ব্যবহৃত হচ্ছে। অতি অল্প সময়ে নির্ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় এ প্রযুক্তির সাহায্যে। আধুনিক এ প্রযুক্তির সুফল পাওয়ার জন্য মাঠের চারপাশে ও বিশ্বকাপের বলে বিশেষ প্রযুক্তির সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে। বলের প্রযুক্তির কথায় একটু পরে আসি। বিশ্বকাপের প্রতিটি স্টেডিয়ামের ছাদের নিচে বসানো হয়েছে ১২টি করে ক্যামেরা। এই ক্যামেরাগুলোর সাহায্যে প্রত্যেক খেলোয়াড়ের শরীরের ২৯টি স্থানের অবস্থান চিহ্নিত করা যায়। এ প্রযুক্তির সাহায্যে প্রতি মিনিটে ৫০ বার পর্যন্ত খেলোয়াড়দের অবস্থান ও দৈহিক ভঙ্গি রেকর্ড করা হয়। তারপর এই অবস্থান থেকে তৈরি করা হয় খেলোয়াড়দের ত্রিমাত্রিক (3D) অবয়ব। যেহেতু বলেও ব্যবহার করা হয়েছে প্রযুক্তি, তাই ত্রিমাত্রিক অবয়ব ও বলের প্রযুক্তির সাহায্যে নিশ্চিত হওয়া যায় খেলোয়াড়দের অবস্থান। বলের প্রযুক্তির সাহায্যে প্রতি সেকেন্ডে ৫০০ বার পর্যন্ত কিক পয়েন্ট ও অবস্থান রেকর্ড করা যায়। এরপর বল ও মানুষের অবস্থান–সম্পর্কিত তথ্য পাঠানো হয় ভিডিও অপারেশন রুমে। সেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে অল্প সময়ে নির্ধারণ করা হয় অফসাইড। সব কাজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে করলে নাম কেন সেমি-অটোমেটেড বা অর্ধস্বয়ংক্রিয়? কারণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি করার সিদ্ধান্ত পাঠানো হয় ম্যাচ অফিশিয়াল ও মাঠে থাকা রেফারির কাছে। তাঁরাই সব দেখে, বিষয়গুলো আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেন, আসলেই অফসাইড হলো কি না। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যেহেতু মানুষ নেন, তাই নাম রাখা হয়েছে অর্ধস্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি।

সেমি-অটোমেটেড অফসাইড প্রযুক্তি
সেমি-অটোমেটেড অফসাইড প্রযুক্তি

আরও পড়ুনস্টেডিয়াম ৯৭৪

বিশ্বকাপের বলে আইএমআই প্রযুক্তি
বিশ্বকাপের বলে আইএমআই প্রযুক্তি

বিশ্বকাপের বলে আইএমআই প্রযুক্তি

বিশ্বকাপের অফিশিয়াল বলের নাম আল রিহলা। অর্থ জার্নি বা ভ্রমণ। বিশ্বকাপের ইতিহাসে বাতাসে সবচেয়ে দ্রুতগামী বল এটি। ম্যাচের গতি আরও বাড়াতে বলটিকে এভাবে ডিজাইন করেছে ক্রীড়াপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাডিডাস। এই বলে ব্যবহার করা হয়েছে ইনার্শিয়াল মেজারমেন্ট ইউনিট (আইএমআই) সেন্সর। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতি সেকেন্ডে ৫০০ বার পর্যন্ত বলের কিক পয়েন্ট ও অবস্থান রেকর্ড করা যায়। ফলে অল্প সময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। আধুনিক এ সেন্সরের সাহায্যে খুব সূক্ষ্ম অফসাইডও ধরা সম্ভব। বলের এ প্রযুক্তি সেমি-অটোমেটেড অফসাইড প্রযুক্তির সঙ্গে মিলে কাজ করে। এ ছাড়া এ বলের রয়েছে কিছু আধুনিক বৈশিষ্ট্য। বলের ভেতরের ফাঁপা অংশ বলের আকৃতি ও বাতাস ধরে রাখার পাশাপাশি ধারাবাহিক গতি নিশ্চিত করে। বলটিতে ব্যবহৃত মানসম্মত চামড়া ঠিক রাখে বলের আকৃতি ও বাতাসের গতিপথ। সব মিলিয়ে এটিই বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক ফুটবল।

সম্পূর্ণ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত স্টেডিয়াম

কাতার বিশ্বকাপে ৮টি স্টেডিয়ামে ৬৪টি খেলা হবে। প্রতিটিতেই আছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মরুর দেশ কাতারের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। এ তাপমাত্রার সঙ্গে স্বাভাবিক হতে পারার কথা নয় খেলোয়াড়দের। এ সমস্যার কথা মাথায় রেখে স্টেডিয়ামে ব্যবহৃত হচ্ছে কুলিং প্রযুক্তি। মানে এই বিশ্বকাপে আট স্টেডিয়ামের মধ্যে সাতটি সম্পূর্ণ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। স্টেডিয়ামের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য আছে বিশেষ ধরনের শীতকব্যবস্থা বা এয়ারকুলার সিস্টেম। এটি আমাদের বাসাবাড়ি বা অফিসে ব্যবহৃত সাধারণ এসির মতো নয়। বিশেষ এই এয়ারকুলার সিস্টেমের জন্য স্টেডিয়ামের পাশে রাখা হয়েছে পানির ব্যবস্থা। এসি ওই পানিকে বাতাসে পরিণত করে স্টেডিয়ামের তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখছে।

স্টেডিয়ামের ভেতরে তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি।
স্টেডিয়ামের ভেতরে তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি।

আরও পড়ুনখেলা দেখার রসায়ন

শুধু স্টেডিয়াম ৯৭৪-এ প্রযুক্তিটি ব্যবহার করা হয়নি। কারণ, এ স্টেডিয়ামের পাশেই সমুদ্র। প্রাকৃতিকভাবে তাই স্টেডিয়ামটির তাপমাত্রা আরামদায়ক। তবে এ স্টেডিয়ামে আছে অন্য প্রযুক্তি। এই প্রথম পরিবহনযোগ্য স্টেডিয়াম তৈরি করেছে কাতার। বিশ্বকাপ শেষে পুরো স্টেডিয়ামটি খুলে ফেলা হবে। সরিয়ে নেওয়া হবে অন্য কোথাও। এই পরিবহনযোগ্যতার পেছনে রয়েছে ৯৭৪টি শিপিং কনটেইনার। ইস্পাতের ফ্রেমে শিপিং কনটেইনার বসিয়ে তৈরি করা হয়েছে খেলোয়াড়দের ড্রেসিংরুম, দর্শকদের জন্য গ্যালারি থেকে শুরু করে বাথরুমসহ সবকিছু। স্টেডিয়ামটির এমন নামকরণের পেছনে কনটেইনারের সংখ্যা ছাড়াও আরেকটি কারণ আছে। কাতারের আন্তর্জাতিক ডায়ালিং কোডও ৯৭৪। এ দুইয়ে মিলিয়ে পরিবেশবান্ধব স্টেডিয়ামটির নাম রাখা হয়েছে স্টেডিয়াম ৯৭৪।

গোললাইন প্রযুক্তি

বল গোলপোস্টের নির্ধারিত রেখা অতিক্রম করেছে কি না, সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় গোললাইন প্রযুক্তি। ২০১৪ সাল থেকে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। গোল হয়েছে কি না, সেটা বোঝার জন্য মাঠে লাগানো হয়েছে ১৪টি ক্যামেরা। বল গোলপোস্টের নির্ধারিত রেখা পেরিয়ে গেলে ম্যাচ রেফারির হাতে থাকা স্মার্টঘড়িতে তথ্য পৌঁছে যায়। ফলে মাঠে থাকা রেফারি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন আরও দ্রুত ও নির্ভুলভাবে। এ ছাড়া ১৪ ক্যামেরা থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে একটি ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশন তৈরি করে দেখানো হয় মাঠের বড় পর্দায়।

গোললাইন প্রযুক্তি
গোললাইন প্রযুক্তি
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের জন্য ‘বেনোকল’ নামে একটি ব্রেইল বিনোদন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছিল।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের জন্য ‘বেনোকল’ নামে একটি ব্রেইল বিনোদন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছিল।

অন্যান্য প্রযুক্তি

ওপরের প্রযুক্তিগুলো ছাড়া আরও অনেক প্রযুক্তির ছড়াছড়ি কাতার বিশ্বকাপে। প্রতিবন্ধী মানুষের খেলা উপভোগের জন্য রাখা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের জন্য ‘বেনোকল’ নামে একটি ব্রেইল বিনোদন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে। এ প্ল্যাটফর্মের অন্তর্ভুক্ত প্রযুক্তি ফিলিং পাম। যন্ত্রটি হাতে পরলে এটি তালুতে প্যাটার্নযুক্ত তথ্য পাঠায়। এর মাধ্যমে একধরনের স্পর্শানুভূতি হয়। ফলে প্রতিবন্ধী যে কেউ নিখুঁতভাবে খেলা উপভোগ করতে পারবেন। মাঠে কখন কী হচ্ছে, সেই আপডেট পেয়ে যাবেন মুহূর্তে।

এ ছাড়া বিশ্বকাপ উপলক্ষে কাতার তৈরি করেছে একটি পূর্ণাঙ্গ ওয়েবসাইট। টিকিট কাটা, হোটেল বুক করা থেকে শুরু করে দর্শনীয় স্থানসহ সবকিছুর তথ্য পাওয়া যাবে একটি অ্যাপে। আলাদাভাবে ভ্রমণকারীদের জন্য বানানো হয়েছে ‘নাভবাডি’ নামের একটি অ্যাপ। কাতার ঘুরে দেখার জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্য পাওয়া যাবে এই অ্যাপে। তা ছাড়া কোন স্টেডিয়াম কোথায়, হাসপাতাল, খাবারের স্থান ইত্যাদি কোথায়, সে সম্পর্কিত সব তথ্য পাওয়া যাবে এতে। কাতারের একটি স্টেডিয়াম থেকে সবচেয়ে দূরের স্টেডিয়ামের পার্থক্য ৫৮ কিলোমিটার। যাতায়াতের জন্য রাখা হয়েছে বৈদ্যুতিক বাস। কোন বাস কখন, কোথা থেকে ছাড়বে, তা-ও জানা যাবে অ্যাপের সাহায্যে। ‘এএসঅ্যাপ’ নামের আরও একটি অ্যাপ বানানো হয়েছে ২০২২ বিশ্বকাপের জন্য। অ্যাপের মাধ্যমে দর্শকেরা গ্যালারিতে বসে খাবারের অর্ডার করতে পারবেন। ফলে টান টান উত্তেজনার মুহূর্তে খাবারের জন্য বাইরে যাওয়া লাগবে না। হুট করে আপনার মুঠোফোনের চার্জ শেষ হলেও ভয় নেই। মাঠের আশপাশে সব সময়ের জন্য থাকবে স্মার্ট ওয়াই–ফাই ও চার্জিং স্টেশন। যেকোনো সময় চার্জ করে নেওয়া যাবে হাতের মুঠোফোনটি।

সব মিলিয়ে এই বিশ্বকাপকে বলা হচ্ছে প্রযুক্তির বিশ্বকাপ। চার বছর পরের বিশ্বকাপে আরও কী কী প্রযুক্তি থাকতে পারে, তা এখন কল্পনাও করা যাচ্ছে না।

লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: ফিফা ডটকম

At HAMKO Future Tech Academy We are dedicated to shaping the future of technology by equipping students with the skills and knowledge needed to excel in the dynamic world of industrial attachment and freelancing programsHAMKO Future Tech Academy

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here