এনএফটি প্রযুক্তির উত্থান ও ভবিষ্যৎ

ওপরের ছবিটা দেখলে হয়তো মনে হতে পারে, ’৯০–এর দশকের কম্পিউটারে ৮-৯ বছরের একটা বাচ্চার করা পিক্সেলেটেড ডিজাইন। কিন্তু কয়েক বাইটের এই অতি সাধারণ ছবিটির মূল্য প্রায় ৬৪ কোটি টাকা। কেন?

উত্তর: এনএফটি—যেটাকে অনেকেই আখ্যায়িত করেছেন ‘ডিজিটাল মালিকানার ভবিষ্যৎ’ নামে। প্রশ্ন হলো, এনএফটি কী?

নন-ফাঞ্জিবল টোকেন বা এনএফটি হলো ইথিরিয়াম ব্লকচেইন প্রযুক্তিচালিত একধরনের ক্রিপ্টো টোকেন। এর দ্বারা কোনো ডিজিটাল ফাইলের মৌলিকত্ব বা অনন্যতা নিশ্চিত করা যায়। এটা করা হয় মূলত কোনো ডিজিটাল ফাইল এনএফটি ব্লকচেইনে অপরিবর্তনশীল ও ইউনিক মেটা-ডেটা নিশ্চিত করার মাধ্যমে। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট সময়ে একটা এনএফটির একটি কপিই শুধু থাকতে পারে এবং সেই ব্লকচেইন ভবিষ্যতে কোনো প্রকার পরিবর্তন করা যায় না। এভাবেই নিশ্চিত করা হয় এনএফটি ইউনিকনেস।

এখন, এনএফটি কীভাবে কাজ করে সেটা বুঝতে গেলে আগে জানতে হবে ফাঞ্জিবিলিটি কী।

ফাঞ্জিবল বলতে এমন কিছুকে বোঝায়, যা একই ধরনের বা ভিন্ন ধরনের যেকোনো জিনিস দ্বারা পরিবর্তনযোগ্য বা বিনিময়যোগ্য। ধরুন, আপনি একটি দোকান থেকে ১০০ টাকার বাজার করলেন। দোকানিকে আপনি এখন একটি ১০০ টাকার নোট দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আপনার কাছে একাধিক ১০০ টাকার নোট থাকলে আপনি যেকোনো একটি ১০০ টাকার নোট দিয়েই দোকানির পাওনা শোধ করে দিতে পারেন। অর্থাৎ আপনার কাছে থাকা সব ১০০ টাকার নোটের মূল্য সমান। অথবা ১০০ টাকার নোটের বদলে আপনি ৫০ টাকার দুটি নোট বা ৫০ টাকার একটি, ২০ টাকার দুটি ও ১০ টাকার একটি নোট দিতে পারেন। সব ক্ষেত্রেই আপনি সমান মূল্য পরিশোধ করছেন। অর্থাৎ ১০০ টাকা পরিশোধ করার ক্ষেত্রে আপনি যেকোনো একটি ১০০ টাকার নোটকে ব্যবহার করতে পারবেন অথবা একটি ১০০ টাকার বদলে আপনি দুটি ৫০ টাকার নোট, পাঁচটি ২০ টাকার নোট কিংবা একটি ৫০ টাকার, দুটি ২০ টাকার ও একটি ১০ টাকার নোট ব্যবহার করতে পারবেন। এখানে ১০০ টাকার নোট হলো ফাঞ্জিবল বা বিনিময়যোগ্য।

নন-ফাঞ্জিবল বা অবিনিময়যোগ্য মানে এমন কিছু, যা একই ধরনের অন্য একটি জিনিস বা ভিন্ন ধরনের কিছুর সঙ্গে পরিবর্তন করা যায় না। যেমন বিখ্যাত চিত্রকর্ম মোনালিসা। চাইলেও মোনালিসাকে এর একটি পোস্টারের সঙ্গে বিনিময় করা যাবে না। কারণ, আসল মোনালিসা চিত্রকর্ম একটিই। কোনো প্রকার অর্থ দিয়ে বা অন্য কোনো চিত্রকর্মকে মোনালিসার বিনিময় হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। কারণ, সেই অর্থ বা অন্য আরেকটি চিত্রকর্ম কখনোই ‘মোনালিসা’ হতে পারবে না। এখানে মোনালিসা হলো নন-ফাঞ্জিবল বা অবিনিময়যোগ্য বস্তু।

এনএফটির মূল ভিতটাও এ রকম। এনএফটি দ্বারা আপনি যেকোনো ডিজিটাল ফাইল বা টেক্সট, যেমন ট্রেডিং কার্ড, আর্ট, ভিডিও, এমনকি টুইটারের টুইটকেও মোনালিসার মতো অনন্য করে ফেলতে পারবেন। এনএফটিকে চিত্রকর্মে শিল্পীর স্বাক্ষরের সঙ্গে তুলনা করা যায়। এই স্বাক্ষর যেমন একটি পেইন্টিংয়ের আসল হওয়ার প্রমাণ, তেমনি এনএফটিও কোনো ডিজিটাল ফাইলের অরিজিনাল বা মূল কপি হওয়ার প্রমাণ।

মোনালিসার যেমন অসংখ্য হুবহু পোস্টার থাকার পরও মোনালিসা হিসেবে সেই একটি চিত্রকর্মকেই মূল্যায়ন করা হয়, তেমনি ওই ডিজিটাল ফাইলগুলোর অসংখ্য কপি থাকলেও আসল কপি একটিই। ওই ডিজিটাল ফাইলকে নন-ফাঞ্জিবল ক্রিপ্টো টোকেন হিসেবে প্রকাশ করার মাধ্যমে এটা নিশ্চিত করা যায়।

ওপরে যে ছবিটি দেখেছেন, তার নাম সাইবারপাঙ্ক #৩১০০। এটা ইন্টারনেট থেকে খুবই সহজে যে কেউই ডাউনলোড করে ব্যবহার করতে পারে বিনা মূল্যে। কিন্তু এর যে আসল এনএফটি ফাইলটা আছে, সেটা কেনার জন্য এর বর্তমান মালিককে গুনতে হয়েছে ৪২০০ ইথার (ইথেরিয়াম ক্রিপ্টোকারেন্সি) বা ৭.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, টাকায় যা প্রায় ৬৪ কোটি!

কথা হচ্ছে, এনএফটির মূল্য এত বেশি কেন? আসলে ইন্টারনেটে এর অসংখ্য কপি থাকলেও এর মূল কপি মাত্র একটি, যা অন্য কোনো ফিজিক্যাল বা ডিজিটাল কিছু দিয়ে বিনিময় করা সম্ভব নয়, ঠিক মোনালিসার মতো। অতি সাধারণ দেখতে ফাইলটির এই অনন্যতার কারণেই এত চড়া দামে এটা কিনে নিয়েছেন অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি।

কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে দামি এনএফটি এটা নয়। সে স্থানটি ‘এভরিডেজ: দ্য ফার্স্ট ৫০০০ ডেজ’-এর দখলে। টাকায় যার মূল্য ৫৮৬ কোটির বেশি।

এবার দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিয়ে ভাবা যাক। প্রথম যে প্রশ্ন নিয়ে বলব, সেটা সম্ভবত সবারই মাথায় এসেছে। এনএফটিগুলো তো ইন্টারনেটে ফ্রিতেই পাওয়া যায়। তাহলে কারা এত চড়া মূল্যে এগুলো কিনছেন এবং কেন?

এর উত্তর আসলে খুব সহজ—এনএফটি অনন্য। কথাটা আগেও বলেছি। এই ফাইলগুলোর একাধিক কপি থাকা সত্ত্বেও আসল কপি একটিই। এবং যাঁরা এই এনএফটি কিনছেন, তাঁদের ধারণা, এই এনএফটির মূল্য আসন্ন বছরগুলোতে কয়েক গুণ হয়ে যাবে। বিটকয়েনের সঙ্গে যেমন হয়েছিল, সে রকম। সেই মুনাফার আশাতেই এনএফটিগুলো এ রকম অযৌক্তিক চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে।

এনএফটি এখন একটি বিলিয়ন ডলারের মার্কেট। আমেরিকার ন্যাশনাল বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশনসহ (এনবিএ) অনেক নামীদামি ভিডিও গেম ও নিলাম কোম্পানি এখন এনএফটির ওপর নিজেদের ভাগ্য পরীক্ষায় নেমেছে। মাত্র এক বছরে এনবিএ ড্যাপার ল্যাবের সহযোগিতায় ‘এনবিএ টপ শট’-এর বেটা ওয়েবসাইটে খেলোয়াড়দের ভিডিও ক্লিপ এনএফটি নিলামের মাধ্যমে আয় করে নিয়েছে প্রায় ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যেহেতু এনএফটির জন্য বিনিয়োগ খুবই সামান্য এবং প্রায় সব ডিজিটাল প্রোপার্টিকে এনএফটি হিসেবে বিক্রি করা যায়, তাই গেমিং ইন্ডাস্ট্রি, কনটেন্ট ক্রিয়েটর, মিউজিশিয়ান থেকে শুরু করে ট্রেডিং কার্ড কোম্পানিসহ সবাই এতে মনোযোগ দিতে ব্যস্ত। এমনকি টুইটারের সিইও, জ্যাক ডোরসির করা প্রথম টুইটটিও এখন এনএফটি হিসেবে নিলামে, যেটি প্রায় ২.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে কিনে নিয়েছেন ব্রিজ ওরাকলের সিইও সিনা ইস্তাভি। এসব থেকে আগত বছরগুলোতে এই ইন্ডাস্ট্রির প্রচণ্ড ঊর্ধ্বগতি আশা করাই স্বাভাবিক।

দ্বিতীয় প্রশ্ন, এনএফটি কি আসলেই ডিজিটাল মালিকানার ভবিষ্যৎ? অনেক বিশ্লেষকের মতে, বিটকয়েনের মতো এনএফটিও একসময়ে বর্তমানের কয়েক গুণ বেশি মূল্যমানে অবস্থান করবে। যদিও অনেকে এই ডিজিটাল অথেনটিসিটির সার্টিফিকেশন নিয়ে আশাবাদী, কিন্তু বিশেষজ্ঞদের অনেকে ধারণা করছেন, অগণিত ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো একসময় এনএফটি হয়তো হারিয়ে যাবে। কিন্তু তারা এটাও স্বীকার করছেন যে ডিজিটাল ওনারশিপ অথেনটিকেশনের এই টোকেন হারিয়ে গেলেও টিকে থাকবে এই প্রযুক্তি, যা ধীরে ধীরে সব ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হবে।

আপাতত এই ব্লকচেইন প্রযুক্তি ডিজিটাল কনটেন্ট ও প্রোপার্টির জন্য ব্যবহৃত হলেও দৈনন্দিন জীবনে এর ব্যবহার খুবই সীমিত। তবে বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, আগামী দু-এক বছরের মধ্যে এই পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে। এনএফটির দৈনন্দিন ব্যবহার শুরু হলে সমাজের নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত সবাই এর সুফল ভোগ করতে পারবে। উদাহরণ হিসেবে বিশ্লেষকেরা বলেছেন জমির মালিকানাজনিত সমস্যার কথা। এখনো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নকল দলিল ও ভুয়া কাগজের জন্য প্রতিদিনই নতুন হাজার হাজার মামলা জমা পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে এই নকল কাগজ এত নিখুঁত হয় যে দেশের বিচার বিভাগও ওই সব মামলার সুরাহা করতে পারে না ঠিকভাবে। কিন্তু যদি এনএফটি প্রযুক্তি এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়, তাহলে আসল ও নকল দলিল ও কাগজপত্র নির্ণয় করা হবে কয়েক সেকেন্ডের কাজ।

পাসপোর্ট ও আইডি জালিয়াতিও এ রকম আরেকটি বড় সমস্যা, যা খুব সহজেই সমাধান করা সম্ভব এনএফটির মাধ্যমে। কারণ, এনএফটি ব্লকচেইন পরবর্তী সময়ে পরিবর্তন করা যায় না এবং যেকোনো সময় এর মাত্র একটি কপিই থাকতে পারে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, বর্তমানে ব্যবহৃত বারকোড বা মাইক্রোচিপ টেকনোলজি থেকে এনএফটি অনেকটাই সুরক্ষিত অথেনটিকেশন–ব্যবস্থা, যার দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ শুধু সময়ের অপেক্ষায়।

At HAMKO Future Tech Academy We are dedicated to shaping the future of technology by equipping students with the skills and knowledge needed to excel in the dynamic world of industrial attachment and freelancing programsHAMKO Future Tech Academy

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here