স্টিভেন ওয়াইনবার্গ: বলের সমন্বয়ক বিগত
চলতে–ফিরতে কত বলেরই না শক্তির বহিঃপ্রকাশ দেখি আমরা! বৈদ্যুতিক বল। চৌম্বকীয় বল। ঘর্ষণ বল। নিউক্লীয় বল। মহাকর্ষ বল। অনেকগুলো বল মিলে মহাবিশ্বের কার্যক্রম চালু রেখেছে। চালু রাখছে প্রকৃতির গতি। বস্তুর গতি দান বা বন্ধ করতে প্রয়োজন এই বল। প্রশ্ন হলো, বলগুলো কি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে? অন্য বলের সঙ্গে সমন্বয় ছাড়াই নিজের কাজ করে যেতে পারে? নাকি সব কটি বলই আসলে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত? মৌলিকভাবে একই বলের ভিন্ন বহিঃপ্রকাশ?
বলগুলো ভিন্ন ভিন্নভাবে স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে কাজ করলে একটি সুসংগঠিত মহাবিশ্ব তৈরি হওয়ার কথা নয়। চোখ বন্ধ করে এক মিনিট ভাবলেই আমরা বুঝতে পারি, সমন্বয়হীনতার অভাবে কীভাবে সিস্টেমে বিপর্যয় ঘটে। তবে চোখ বন্ধ করে ভাবনা দিয়ে বৈজ্ঞানিক সত্য প্রতিষ্ঠা পায় না। সিদ্ধান্ত নিতে চাই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুসরণ।
প্রকৃতির মৌলিক বল চারটি। মহাকর্ষ কাজ করে মহাবিশ্বের বড় মাপকাঠির জিনিস নিয়ে। বাকি বলগুলোর কাজ বস্তুকণার গহিনে। সবল ও দুর্বল নিউক্লীয় বল এবং বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় বল। বাকি সব বলই কোনো না কোনোভাবে এই বলগুলোর রূপ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই যেমন ঘর্ষণ বলের কথাই ধরুন। বলটি হলো গতির প্রতিবন্ধক। আবার এই বল ছাড়াও গতির সূচনা অনেক সময় অসম্ভব। সে যা–ই হোক, অন্তর্নিহিতভাবে জটিল এই বল মূলত বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় বলের বহিঃপ্রকাশ বলে বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস। বর্তমানে জানা চারটি মৌলিক বল ছাড়া বাকি সব বলই ঘর্ষণের মতো অমৌলিক। চারটি বলের কোনো না কোনোটির রূপভেদ।https://imasdk.googleapis.com/js/core/bridge3.563.0_en.html#goog_72368642
এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, তথাকথিত চারটি মৌলিক বলও কি আসলেই মৌলিক? এগুলোর দুই বা কয়েকটিকে কি একই বলের আওতায় নিয়ে আসা যায়? এমন চিন্তার বিপ্লব মূলত শুরু হয়েছিল চিরায়ত একীভূত ক্ষেত্র তত্ত্বের মাধ্যমে। যার মাধ্যমে ওয়েরস্টেড, ফ্যারাডের পর্যবেক্ষণ কাজে লাগিয়ে ম্যাক্সওয়েল চৌম্বকীয় ও বৈদ্যুতিক বলকে সমন্বয় করেছিলেন। সেই বিপ্লবের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সাফল্য ধরা দেয় স্টিভেন ওয়াইনবার্গদের মাধ্যমে। বিজ্ঞানী আবদুস সালাম এবং শেলডন গ্ল্যাশোর সঙ্গে সঙ্গে অবদান রাখেন বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় ও দুর্বল নিউক্লীয় বলকে (সংক্ষেপে দুর্বল বল) একীভূত করার ক্ষেত্রে। আর তাই বিজ্ঞানের ইতিহাস চিরকাল যাঁদের নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে, তাঁদের অন্যতম ওয়াইনবার্গ।
১৬ বছর বয়সে বিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহী হয়ে ওঠেন ওয়াইনবার্গ। এক ভাইয়ের কাছ থেকে একটি রসায়ন কিট পেয়ে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। ওই বয়সেই সিদ্ধান্ত নেন, বড় হয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা পড়বেন। জন্ম ১৯৩৩ সালে। ১৯৫০ সালে ব্রংক্স হাইস্কুল অব সায়েন্স থেকে পাস করে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই স্কুলেই তাঁর সহপাঠী ছিলেন ভবিষ্যতে নোবেল পুরস্কারের অংশীদার শেলডন গ্ল্যাশো। ডিগ্রি নিয়ে চার বছর শেষে চলে আসেন কোপেনহেগেনের নীলস বোর ইনস্টিটিউটে। এখানে এক বছর থেকে চলে আসেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাত্র দুই বছরে পিএইচডি অর্জন করে ওয়াইনবার্গ হয়ে যান ড. ওয়াইনবার্গ।
পিএইচডি শেষে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও বার্কলেতে গবেষণা করেন। গবেষণার বিষয়গুলো অত্যন্ত উঁচু মানের। উচ্চ শক্তির কোয়ান্টাম ফিল্ড তত্ত্ব, প্রতিসাম্য ভাঙন, পাইওন কণার বিক্ষেপণ, অবলোহিত ফোটন, কোয়ান্টাম মহাকর্ষ ইত্যাদি। এই সময়েই তিনি লেখেন দ্য কোয়ান্টাম থিওরি অব ফিল্ডস নামের তিন খণ্ডের ও ১ হাজার ৫০০–এর বেশি পৃষ্ঠার বইখানা। এই শাখায় এটা একেবারে প্রথম সারির একটি বই।
১৯৬৬ সালে ওয়াইনবার্গ হার্ভার্ডের প্রভাষক। পরের বছর এমআইটিতে যোগ দেন ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে। এখানে এসেই তিনি নোবেল পাওয়া কাজটি করেন। বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় ও দুর্বল বলকে একীভূত করার মডেল প্রস্তাব করেন। এই মডেলকেই এখন আমরা ইলেকট্রোউইক বা তড়িৎদুর্বল বল হিসেবে জানি। মডেল অনুসারে বলের দুর্বল অংশের বলবাহী কণাগুলোর ভরের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিসাম্য ভাঙনের মাধ্যমে। এই মডেলেরই একটি দিক ছিল হিগস বোসন বা ঈশ্বর কণার পূর্বানুমান। ওয়াইনবার্গ যে গবেষণাপত্রে এই তত্ত্ব প্রকাশ করেন, সেটি উচ্চ শক্তির পদার্থবিদ্যায় অন্যতম বেশি উদ্ধৃতি পাওয়া একটি পেপার।
ব্যাপারটি নিয়ে গ্ল্যাশো ১৯৬৩ সালেই কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি প্রস্তাব করেন, বৈদ্যুতিক, চৌম্বকীয় ও দুর্বল বল সম্ভবত আংশিক একীভূত তড়িৎদুর্বল বল থেকে এসে থাকতে পারে। ১৯৬৭ সালে ওয়াইনবার্গ ও আবদুস সালাম স্বতন্ত্রভাবে মডেলটিকে সংশোধন করেন। তাঁরা দেখান, বলবাহী ডব্লিউ ও জেড কণার ভর হিগস কৌশলের মাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিসাম্য ভাঙন থেকেই পাওয়া যায়। একীভূত এই তড়িৎদুর্বল বল চারটি কণা দিয়ে কাজ করে। বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় অংশের জন্য ফোটন আর দুর্বল বলের জন্য একটি নিরপেক্ষ জেড কণা ও দুটি চার্জিত ডব্লিউ কণা কাজ করে।
দুর্বল নিরপেক্ষ প্রবাহ আবিষ্কারের মাধ্যমে ১৯৭৩ সালে এ তত্ত্ব প্রথম পরীক্ষামূলক সমর্থন পায়। ১৯৮৩ সালে সার্নের গবেষণাগারে কার্লো রুবিয়ার দল ডব্লিউ ও জেড বোসন প্রস্তুত করেন। অবশ্য তার আগেই ১৯৭৯ সালে তিন বিজ্ঞানী—শেলডন, ওয়াইনবার্গ ও সালাম তত্ত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেছেন। রুবিয়ারাও বাদ যাননি। তিনি ও সিমন ভ্যান ডার মির ১৯৮৪ সালে সম্মানজনক এই পুরস্কারে ভূষিত হন।
বিজ্ঞানমনস্কদের একটাই আশা: ওয়াইনবার্গদের মতো ক্ষণজন্মা ব্যক্তিরা যেন ক্ষণে ক্ষণে নয়, প্রতিক্ষণে জন্ম নেন।
ওয়াইনবার্গদের সাফল্য আরও আরও বলকে একীভূত করতে বিজ্ঞানীদের উৎসাহ দেয়। ১৯৭৪ সালেই গ্ল্যাশো ও হাওয়ার্ড জর্জি প্রস্তাব করেন প্রথম মহাএকীভূত ক্ষেত্র তত্ত্ব। যেখানে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের তিন তত্ত্বকে (মহাকর্ষ ছাড়া বাকি তিন) একীভূত আকারে দেখানো যেতে পারে। বর্তমানে অনেকগুলো মহাএকীভূত ক্ষেত্র তত্ত্ব প্রস্তাবিত থাকলেও পর্যবেক্ষণমূলক প্রমাণ নেই।
১৯৭৩ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ওয়াইনবার্গ ছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউজিন হিগিনস প্রফেসর অব ফিজিকস। ১৯৭৯ সালে তিনি কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্বের পুনঃসাধারণীকরণের (Renormalization) আধুনিক ধারণার প্রবর্তন করেন। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তত্ত্ব থেকে অসীম রাশিকে এড়িয়ে যাওয়ার পথ পাওয়া যায়। তাঁর এ কাজের মাধ্যমে ফলপ্রসূ কোয়ান্টাম মহাকর্ষ তত্ত্ব তৈরির পথ খুলে যায়।
তাত্ত্বিক পদার্থবিদ পিটার ওয়িটের মতে, তাত্ত্বিক কণাপদার্থবিদ্যার সবচেয়ে সফল যুগটিতে (ষাটের দশক থেকে আশির দশকের শেষ দিক) ওয়াইনবার্গ ছিলেন তর্কযোগ্যভাবে সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষ। তাঁর নোবেলজয়ী আবিষ্কারকে ওয়িট পদার্থবিদ্যা সম্পর্কে আমাদের সেরা মৌলিক জ্ঞান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ওয়াইনবার্গকে নিয়ে প্রশংসার কলম চলেছে প্রথিতযশা বিজ্ঞানীদের। তাঁদের মধ্যে আছেন রিচার্ড ফাইনম্যান, মারে গেল-মান, জন প্রেস্কিল, ব্রায়ান গ্রিনদের মতো বিজ্ঞানীরা।
তাঁর বিখ্যাত জনপ্রিয় বই দ্য ফার্স্ট থ্রি মিনিটস: আ মডার্ন ভিউ অব দ্য অরিজিন অব দ্য ইউনিভার্স। বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে মহাবিশ্বের জন্ম ও তার পরবর্তী প্রসারণের ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন এতে তিনি। জীবনের শেষের দিকে তিনি অধ্যাপনার পাশাপাশি বিজ্ঞানের ইতিহাসের দিকে মন দেন। ২০১৫ সালে লেখেন টু এক্সপ্লেইন দ্য ওয়ার্ল্ড: দ্য ডিসকভারি অব মডার্ন সায়েন্স। ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় থার্ড থটস। বিজ্ঞানবিষয়ক ২৫টি অসাধারণ লেখার এই সংকলন ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়।
গত ২৩ জুলাই তিনি স্ত্রী লয়েস ওয়াইনবার্গ ও কন্যা এলিজাবেথকে রেখে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁর ঝুড়িতে যুক্ত হয়েছে এক ডজনের বেশি পুরস্কার ও সম্মাননা। ইয়েল, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়সহ ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সম্মানসূচক পিএইচডি পেয়েছেন। পেয়েছেন জেমস ম্যাডিসন মেডেল, ন্যাশনাল মেডেল অব সায়েন্সসহ বহু উল্লেখযোগ্য পুরস্কার। সর্বশেষ ২০২০ সালে পেয়েছেন ব্রেকথ্রু প্রাইজ।
বিজ্ঞানমনস্কদের একটাই আশা: ওয়াইনবার্গদের মতো ক্ষণজন্মা ব্যক্তিরা যেন ক্ষণে ক্ষণে নয়, প্রতিক্ষণে জন্ম নেন। যাঁদের হাত ধরে উন্মোচিত হবে মহাবিশ্বের রহস্য। হয়তোবা সব কটি বলকে তাঁরা একীভূত করবেন। আমরা মহাবিশ্বকে বুঝতে পারব আরও সহজ করে। নাকি জটিল করে!