শূন্যে ভাসা রেলগাড়ি

প্রচণ্ড বেগে ছুটে গেল রেলগাড়ি। মাটি না ছুঁয়ে। শূন্যে ভেসে ভেসে। বহু বিজ্ঞানী বহু বছর ধরে চেষ্টা করছেন এ স্বপ্নটাকে সত্যি করতে। তাঁদের এই স্বপ্ন সত্যি হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে কক্ষ তাপমাত্রার সুপার কন্ডাক্টর।

সুপার কন্ডাক্টর আবিষ্কৃত হয় প্রায় একশ বছর আগে, ১৯১১ সালে। পদার্থবিদ হেইক অনেস দেখতে পান, ২০ কেলভিনের কম তাপমাত্রায় কিছু কিছু পদার্থের রোধ প্রায় শূন্য। অর্থাৎ, ইলেকট্রনগুলো একদম বিনা বাধায় এর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। এর আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো মাইসন ইফেক্ট।

পরমাণুর ভেতরে ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের চারপাশে নির্দিষ্ট কক্ষপথে থাকে। এসব ইলেকট্রনের আবার স্পিন আছে। দুই রকমের স্পিন দেখা যায়। একটা স্পিন আরেকটার বিপরীত। অর্থাৎ একই শক্তিস্তরে থাকা জোড়বদ্ধ দুটো ইলেকট্রনের একটির স্পিন +১/২ হলে অন্যটার হয় -১/২। আর চার্জযুক্ত কণার পরস্পর বিপরীতমুখি স্পিনের ফলে সৃষ্টি হয় দুরকম চৌম্বকক্ষেত্র। অর্থাৎ দুরকম মেরুর দেখা পাওয়া যায়। একটি উত্তর মেরু, অপরটি দক্ষিণ মেরু। কোনো পদার্থে বিশেষ কোনো মেরুর উপস্থিতি বেশি থাকলে এর একপ্রান্ত সেই মেরুর ধর্ম প্রদর্শন করে। অপর প্রান্ত প্রদর্শন করে তার বিপরীত মেরুর ধর্ম। এখন, দুটি চুম্বকের সমমেরু যদি কাছাকাছি আসে, তবে সেটি পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। তার মানে, একই মেরুর দুটো ইলেকট্রনকে যদি কাছাকাছি আনা যায়, তাহলে সেগুলো পরস্পরকে বিকর্ষণ করবে। এটাই মাইসন ইফেক্ট। শূন্যে ভাসা রেলগাড়ির মূল ভিত্তিও এটাই।

কোনো রেলগাড়ির বগির নিচে কয়েকটা সুপার কন্ডাক্টরের পাত আর রেললাইনে তড়িৎচুম্বক বল যুক্ত করে দিলেই হয়। তখন রেললাইনে বিদ্যুৎ বাড়িয়ে কমিয়ে রেলগাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

কিন্তু এই প্রযুক্তির কী দরকার? এর সুবিধাগুলো কী কী?

আসলে রেলের চাকা আর লাইনের পাতের মধ্যকার ঘর্ষণ এড়ানোর জন্য এই প্রযুক্তির আবির্ভাব। রেললাইনের ওপর দিয়ে ট্রেন যাবার পর স্পর্শ করলে দেখা যায় কেমন গরম হয়। এর ফলে নষ্ট হয় প্রচুর জ্বালানি। সুপার কন্ডাক্টর এসে গেলে এই জ্বালানি আর নষ্ট হবে না। কেবল লাগবে বিদ্যুৎ, যা আসবে রেললাইনের পাশে স্থাপিত সোলার প্যানেল থেকে। এভাবে প্রায় বিনা খরচে প্রাকৃতিক নবায়নযোগ্য সম্পদের সাহায্যে হাজার হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ করা যাবে। নিউটনের প্রথম সূত্রটি বলে, কোনো গতিশীল বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ না করলে সেটা সবসময় গতিশীল থাকবে। একই কথা প্রযোজ্য স্থির বস্তুর জন্যও।

শূন্যে ভাসা ট্রেনের ক্ষেত্রে বাতাসের বাধা ছাড়া আর কোনো বাধা নেই। অ্যারো ডাইনামিক ডিজাইন করে একেও শূন্যের কাছে নামিয়ে আনা যায়। ট্রেন চালু করতে শুরুতে একবার শক্তি দিলে সেটা দিয়েই অনেকক্ষণ চলা যাবে। আর ইচ্ছে যদি থাকে গতিদানব হওয়ার, তাতেও বাধা নেই। তবে আরও কিছুটা শক্তি দিতে হবে সে জন্য। এখন যে পরিমাণ শক্তি ব্যবহার করে ময়মনসিংহ থেকে একটি ট্রেন ঢাকা যায়, সে পরিমাণ শক্তি দিয়েই হয়তো ভারতের নয়া দিল্লি চলে যাওয়া যাবে।

শূন্যে ভাসা রেলগাড়ি

প্রশ্ন হচ্ছে, সাধারণ চুম্বক ব্যবহার করলে কি এটা হতো না? উত্তর হচ্ছে, না। কারণ, চুম্বকের মেরু সহজে পরিবর্তন করা যায় না। আর চলন্ত ট্রেনে তড়িৎচুম্বক বল যুক্ত করা নিশ্চয়ই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাছাড়া, চলন্ত ট্রেনে এত বিদ্যুৎ আসবে কোথা থেকে? আর চুম্বক তৈরি মোটামুটি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল একটি প্রক্রিয়া। সে তুলনায় সুপারকন্ডাক্টর বেশ কার্যকর। তবু চুম্বক ব্যবহার করে উন্নত দেশগুলো শূন্যে ভাসা ট্রেন বানিয়েছে। কিন্তু এর জন্য এক মাইল যেতে যে খরচ পড়ছে, তা দিয়ে কয়েক শ গাড়ি একটা চার লেনের রাস্তা দিয়ে যেতে পারবে।

এতটুকু পড়ে নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে, সুপার কন্ডাক্টরের ট্রেন এখনো চালু হচ্ছে না কেন? সেই প্রাচীন সমস্যা! বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? কক্ষ তাপমাত্রার সুপার কন্ডাক্টরই যে নেই!

এখন পর্যন্ত পাওয়া সুপারকন্ডাক্টরটি মাইনাস ১৩৮ কেলভিন বা মাইনাস ১৩৫ কেলভিন ডিগ্রি সেলসিয়াসে তার চুম্বক দর্পন (ম্যাগনেটিক মিরর) ধর্ম প্রদর্শন করে। সেটি হচ্ছে মার্কারি-থ্যালিয়াম-বেরিয়াম-ক্যালশিয়াম-কপার অক্সাইড। তবে এটা এত কম নয়! তরল নাইট্রোজেন ব্যবহার করে এই তাপমাত্রা সহজেই পাওয়া যায়, যার দাম প্রায় দুধের সমান। এটি ৭৭ কেলভিন তাপমাত্রায় তরল। কিন্তু এত ঠান্ডা আর বিপদজনক পদার্থ নিয়ে কেউ ট্রেনে উঠতে চাইবে না।

তাই এমন সুপার কন্ডাক্টরের খোঁজ চলছে, যেটা কক্ষতাপমাত্রায় তার চুম্বক দর্পন ধর্ম প্রকাশ করবে। হতাশার কথা হলো, এ ধরনের পদার্থের রাসায়নিক ধর্ম কেমন হবে তা ব্যাখ্যা করার মতো জ্ঞান আমাদের নেই। তাই খোঁজ চলছে ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ পদ্ধতিতে। এ পদ্ধতিতে হয়তো আজই পাওয়া যেতে পারে অমূল্য বস্তু অথবা হাজার বছর পরেও নাও পাওয়া যেতে পারে। তবে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বে ঘটে যাবে আরেকটি শিল্প বিপ্লব।

এর থেকে ভালো পদ্ধতি হচ্ছে, উপযুক্ত জ্ঞান আহরণ করে এর রাসায়নিক ধর্ম ব্যাখ্যা করা। আর সে অনুযায়ী কক্ষ তাপমাত্রার সুপারকন্ডাক্টর তৈরি করা। তাতে শুধু রেলগাড়ি নয়, ঘর্ষণজনিত সকল প্রকার শক্তি অপচয় হ্রাস পাবে।

At HAMKO Future Tech Academy We are dedicated to shaping the future of technology by equipping students with the skills and knowledge needed to excel in the dynamic world of industrial attachment and freelancing programsHAMKO Future Tech Academy

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here