প্রযুক্তির বাঁক এবং আমাদের প্রস্তুতি
আমরা বর্তমানে একটি প্রযুক্তির বাঁকে অবস্থান করছি। কিছুদিন আগে যে জিনিস যেভাবে করতাম, এখন তার পরিবর্তন হচ্ছে এবং হতেই থাকবে। ব্যাংকে আগের সেই লাইন আর নেই, অফিসে এত এত কাগজের ব্যবহার কমে আসছে, বেচাকেনা এমনকি ট্যাক্সি–সিএনজিচালিত অটোরিকশা ডাকতেও পদ্ধতির পরিবর্তন হচ্ছে। এসবের সঙ্গে এখনো আমরা পুরোপুরি অভ্যস্ত হতে পারিনি। এখনো আমরা হাইব্রিড অবস্থায় রয়েছি (ম্যানুয়াল ও প্রযুক্তির সহায়তা—দুটোই ব্যবহার করছি)। কিন্তু পরিবর্তনগুলো হচ্ছে খুব দ্রুত। এখন আমাদের বড় একটি সময় কাটছে প্রযুক্তির সঙ্গে অনলাইনে। কখনো কিছু খোঁজাখুঁজি, কখনো পড়ালেখা, কখনো কোনো ডকুমেন্টারি দেখা থেকে শুরু করে বিনোদনের পুরো দায়িত্ব এখন প্রযুক্তি নিয়ে নিয়েছে। যাচ্ছি কোন দিকে? হচ্ছেটা কী?
এই আলোচনা এগিয়ে নিতে হলে দেখতে হবে বর্তমান দুনিয়ায় অর্থপ্রবাহ কোন দিকে যাচ্ছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৮–এর সবচেয়ে বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় সব কটিই আইটিভিত্তিক। এর মধ্যে রয়েছে অ্যাপল, অ্যামাজন, অ্যালফাবেট, মাইক্রোসফট, ফেসবুক, আলিবাবা, স্যামসাং ইত্যাদি। ইন্টেল, সিসকো, টেসলা, স্পেসএক্স এগুলোও খুব বেশি পিছিয়ে নেই। দেখতে হবে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণার কোন দিকে বিনিয়োগ করছে, কেন করছে? ইদানীং বহুল আলোচিত শব্দগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্লাউড কম্পিউটিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, স্যাটেলাইট, স্বয়ংক্রিয় গাড়ি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, আইওটি, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, মেশিন লার্নিং, কম্পিউটিং সিকিউরিটি, গ্রিন কম্পিউটিং, বিটকয়েন, রোবটিকস ইত্যাদি।
কেন এই শব্দগুলো এত গুরুত্ব পাচ্ছে? দেখতে পাচ্ছি যে প্রসেসরের গতি আর কোনোভাবেই বাড়ানো যাচ্ছে না, ৪ গিগাহার্জের ওপরে ওঠাতে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে অস্বাভাবিকভাবে। তাই কোর বাড়িয়ে গতির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাই এখন সিলিকন জার্মেনিয়ামের বিকল্প উপাদানের খোঁজ করা হচ্ছে, যা দিয়ে প্রসেসরের গতি বাড়ানো সম্ভব। কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো নতুন ধরনের কম্পিউটিং সিস্টেমের সম্ভাব্যতা উন্নয়নের গবেষণাও অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে চলছে। গতি ও মেমোরির ধারণশক্তি এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, এখন সব ডেটা প্রসেস ও ধারণের কাজ করা হবে ক্লাউডে। এই যেমন আমরাই এখন যেকোনো ফাইল গুগল ড্রাইভে রাখতে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আর গেম ও আর্থিক লেনদেনের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠছে অনলাইন। ভবিষ্যতে ভিডিও এডিটিং, অ্যানিমেশনের কাজও হবে ক্লাউডে। এ ছাড়া প্রতি সেকেন্ডে সোশ্যাল মিডিয়া, ই-কমার্স, ওয়েবভিত্তিক সার্ভিসসহ আইওটি ডিভাইসগুলো ট্যারাবাইট পরিমাণ ডেটা তৈরি করবে, যা সংরক্ষণ ও প্রসেসরের প্রয়োজন পড়বে। এর জন্য প্রয়োজন হবে অবিশ্বাস্য রকমের গতিসম্পন্ন কম্পিউটিং, ডেটা ধারণক্ষমতা ও যোগাযোগব্যবস্থা। কাজেই ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স ও কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো নতুন ধরনের কম্পিউটিং উদ্ভাবনের গবেষণায় আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের সম্পৃক্ত করা এখন সময়ের দাবি। যদিও খরচের কারণে ব্যবহারিক গবেষণা কঠিন হতে পারে, কিন্তু সিমুলেশনভিত্তিক তাত্ত্বিক গবেষণার সম্ভাবনাকে আমাদের নতুন প্রজন্মের গ্রহণ করতে হবে।
ভবিষ্যতে তথ্য হয়ে উঠবে অমূল্য সম্পদ। মানুষ তাদের ভবিষ্যতের প্রয়োজনের সমাধান তথ্যকে প্রক্রিয়াকরণ করেই পেয়ে যাবে। এর জন্য ব্যবহার করা হবে ডেটা মাইনিং, মেশিন লার্নিং, ডিপ লার্নিংয়ের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন পদ্ধতি। ডেটা সায়েন্স, বিগ ডেটা অ্যানালাইসিস করার মতো টুলসের সঙ্গে পরিচিতি না হলে, এগুলো ব্যবহার করতে না পারলে আমরা ভবিষ্যতে বিশাল অঙ্কের উপার্জন থেকে পিছিয়ে থাকব। বলাবাহুল্য, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট মার্কেট ইতিমধ্যে ভারতের হাতে চলে গেছে। কাজেই এআই (কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা) হতে পারে আমাদের এই বাজারে প্রবেশ করার এবং ভাগ বসানোর একমাত্র হাতিয়ার। এসব বিষয় যেহেতু সবই সফটওয়্যারভিত্তিক, তাই অর্জনীয় এই সাফল্যের সঙ্গে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে হবে ও ভীষণভাবে উপযোগী করে তুলতে হবে।
এবার আসা যাক, এই তথ্যের নিরাপত্তাবিষয়ক আলোচনায়। ভবিষ্যতে অসংখ্য আইওটি ডিভাইস ইন্টারনেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে এবং ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সব তথ্যই থাকবে ক্লাউডে। কাজেই তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণা চলছে, চলবে। এ ছাড়া হ্যাকার, স্পাই স্প্যাইওয়্যার, টেজার ও ভাইরাসের আক্রমণ থেকে কম্পিউটার ও তথ্যের নিরাপত্তা রক্ষা করা হবে ভবিষ্যতের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়াতে বুলিং, হুমকি, গুজব, মানহানি, অশ্লীলতা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে সাইবার আইন জানার পাশাপাশি উচ্চমানের সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণায় সম্পৃক্ততা ভবিষ্যতের নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের জন্য অতি জরুরি বিষয়। ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে যে আমরা অপারেটিং সিস্টেম পাইরেটেড ভার্সন ব্যবহার করলেও অ্যান্টিভাইরাস ঠিকই কিনে ব্যবহার করছি। কাজেই আর্থিক বাজার হিসেবেও ডেটা সিকিউরিটি বা সাইবার নিরাপত্তার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
একটি দিকে মনে হয় আমরা সুন্দর প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছি। সেটা হলো রোবটিকস, আইওটি এবং এমবেডেড সিস্টেমে ইনোভেশন। প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং আমাদের ছেলেমেয়েরা প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিকভাবে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছে। আমরা প্রযুক্তির উন্নয়নের দিকে নজর দিলে খুব সহজেই বুঝতে পারি যে মানুষের কঠিন, অসাধ্য ও বিরক্তিকর কাজকে সহজ করতে রোবট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ইতিমধ্যেই স্বয়ংক্রিয় কারখানা, রোগনির্ণয় ও স্বাস্থ্য খাতে রোবটিকসের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া সোশ্যাল রোবটের জনপ্রিয়তাও প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। বাজারে এখনই উঁচু ভবনগুলোতে রঙের কাজ করা, কাচ পরিষ্কার করা, ড্রেন পরিষ্কার করা, ময়লা ম্যানেজমেন্টের জন্য ও বাসাবাড়িতে কাজের জন্য রোবটের চাহিদা রয়েছে। উদ্ধারকাজ ও নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য সহায়ক হিসেবে বিশেষ রোবট, পানির নিচে চলার উপযোগী ক্ষুদ্র জলযান ও কোয়াডকাপ্টারের ব্যবহার এখন সময়ের দাবি। একদিকে এগুলো যেমন মানবজীবন রক্ষা করতে পারবে, অন্যদিকে আমাদের সক্ষমতার প্রমাণ রেখে যাবে।
রোবটিকসের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হলো স্মার্ট বা এমবেডেড সিস্টেম। প্রতিদিন নিত্যনতুন গ্যাজেট এবং ইলেকট্রনিকস পণ্য বাজারে ঢুকছে। এগুলোর বেশির ভাগের মধ্যেই রয়েছে ক্ষুদ্রাকৃতির কম্পিউটার। ফলে অতিসহজেই অন্য যন্ত্রের সঙ্গে তারবিহীনভাবেই সংযুক্ত হতে পারে, যেমন স্মার্ট ঘড়ি, ট্র্যাকার, স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষক ঘড়ি, হোম অটোমেশন, ভিডিও গেম ইত্যাদি। এই ধরনের গেজেট ভবিষ্যতে কৃষি থেকে শুরু করে বাচ্চা ও নারীদের নিরাপত্তাবিষয়ক সমস্যার সমাধানেও ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। এমনকি অপ্রয়োজনেও অদ্ভুত অদ্ভুত সব গেজেট তৈরি হতে থাকবে, যার বিশাল ক্রেতা থাকবে আন্তর্জাতিক বাজারে। শোনা যাচ্ছে, চীন এখন ব্র্যান্ডের পণ্য তৈরিতে গুরুত্ব দেবে। সে ক্ষেত্রে চীনের বর্তমান নন-ব্র্যান্ডের পণ্যের উৎপাদনের বাজার আসতে পারে বাংলাদেশের দিকে। বাংলাদেশেরও এই সুযোগ গ্রহণ করা উচিত। তাহলে ইলেকট্রনিকস ও হার্ডওয়্যার প্রোগ্রামিং জানা ছেলেমেয়ের বিরাট চাহিদা দেশে ও আন্তর্জাতিক বাজারে শিগগিরই তৈরি হতে যাচ্ছে। আমরা প্রস্তুত তো?
ভবিষ্যতে সব স্থানে ইন্টারনেট, লোকেশনভিত্তিক সার্ভিস এবং রিমোট সেন্সিংয়ে ক্ষুদ্র স্যাটেলাইট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে যাচ্ছ। ব্যাটারিচালিত স্বয়ংক্রিয় যান, ব্রেন কম্পিউটার ইন্টাফেসিং (বিসিআই), হিউম্যান কম্পিউটার ইন্টারফেস (এইচসিআই), গ্রিন কম্পিউটিং, রিনিউঅ্যাবল এনার্জি ইত্যাদি সবই ভবিষ্যতের জন্য দারুণ সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। আমাদের এখন থেকেই এসব কিছুর গবেষণা, তৈরি ও উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হবে।
এখন মানুষ টিভির পাশাপাশি নেটফ্লিক্স ও ইউটিউব চ্যানেলের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, কাগুজে পত্রিকার পাশাপাশি অনলাইন পত্রিকাও নিয়মিত দেখছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পাশাপাশি অনলাইন কোর্সেও ভর্তি হচ্ছে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে অটোরিকশা ডাকার পাশাপাশি অ্যাপ দিয়ে ট্যাক্সি বা মোটরসাইকেল রাইড শেয়ার নিচ্ছে। বাজারে যাওয়ার পাশাপাশি অনলাইনেও প্রচুর কেনাকাটা করছে। এসব অস্বীকার করার উপায় নেই। এসব সার্ভিস ব্যবহারের পাশাপাশি এমন সার্ভিস তৈরিতে সম্পৃক্ত না থাকতে পারলে ফেসবুক-ইউটিউব নিয়ে যাবে অ্যাডভার্টাইজমেন্টের টাকা, গুগল-অ্যামাজন নিয়ে যাবে সার্ভিস দেওয়ার টাকা আর মোবাইল তো আমরা অ্যাপল কিংবা স্যামসাংই ব্যবহার করব, তা–ই না? শুধু কি গার্মেন্টসের মেয়েদের আর বিদেশে খেটে খাওয়া শ্রমিকদের রক্ত পানি করা অর্থে আমরা পায়ের ওপরে পা তুলে আরামের ঢেকুর ছাড়ব, নাকি মেধা দিয়ে কিছু স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে আসব, সেটা এখনই ভাবতে হবে, সেই সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে।