ডিএনএ সিকোয়েন্সিং ও কম্পিউটার সায়েন্স
২০০৩ সালে হিউম্যান জিনোম প্রকল্পের সফল সমাপ্তি ঘটে। পাক্কা ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে। এই প্রকল্পে পুরো মানব জিনোমটির প্রথমবারের মতো সিকোয়েন্স হয়েছিল এবং এ প্রকল্পে সময় লেগেছিল ১৩ বছর। অথচ আজ মানব জিনোম দুই দিনেরও কম সময়ে মাত্র ১০০০ ডলারে সিকোয়েন্স করা যায়। গবেষকেরা আশা করছেন আগামী ১০ বছরের মধ্যে এই ব্যয় মাত্র ১০০ ডলারে নামিয়ে আনা সম্ভব। এটা সত্য যে হিউম্যান জিনোম প্রকল্প থেকে লাভ করা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানটি ডিএনএ সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তিটিকে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে আসতে সহায়তা করেছে। তবে প্রকল্পের সাফল্যের আরেকটি প্রধান কারণ হচ্ছে কম্পিউটার সায়েন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অগ্রগতি।
বর্তমান এবং ২০০৩ সালের কম্পিউটারগুলোর মধ্যে অন্যতম বড় পার্থক্য হলো স্টোরেজ ব্যবস্থা এবং প্রক্রিয়াকরণের গতি। প্রযুক্তির উন্নতিই দুই দশক আগের যন্ত্রের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ডিএনএ সিকোয়েন্সিং কৌশল চালু করতে সাহায্য করেছিল। হিউম্যান জিনোম প্রকল্পে ব্যবহৃত স্যাঙ্গার সিকোয়েন্সিং পদ্ধতিটি একবারে ডিএনএর ছোট ছোট টুকরা পড়তে পারে। এই পদ্ধতি ওভারল্যাপিং রিডগুলোর দীর্ঘতর স্ট্যান্ড তৈরি এবং শেষ পর্যন্ত পুরো জিনোমকে একত্র করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল।
নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং (এনজিএস) বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত কৌশল। একই সঙ্গে অনেকগুলো মাইক্রো-স্কেল প্রতিক্রিয়াগুলোকে সমান্তরাল করে কাজ করে। ফলে এনজিএস সিস্টেম স্যানগার সিকোয়েন্সিংয়ের চেয়ে প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার গুণ বেশি আউটপুট দেয়। এ ছাড়া এনজিএস মেশিনের সাহায্যে বিজ্ঞানীরা একটি পুরো জিনোমকে স্যাঙ্গার সিকোয়েন্সারের তুলনায় কম সময়ে এবং মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে সিকোয়েন্স করতে পারে। প্রক্রিয়াকরণ শক্তি এবং ডেটা তৈরির গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্টোরেজ ক্ষমতাও বাড়ানো আবশ্যক। কারণ একটি এনজিএস মেশিন এক দিনে এক টেরাবাইট ডেটা তৈরি করতে পারে। হার্ডড্রাইভের স্পেস এবং র৵াম মেমোরি উন্নত হওয়ার কারণে এনজিএস সিকোয়েন্সাররা সমপরিমাণ তথ্য সংরক্ষণ করতে পারেন। কম্পিউটারের স্টোরেজ ক্ষমতা প্রক্রিয়াকরণের গতি না বাড়লে এটা সম্ভব ছিল না। কম্পিউটারের এই কার্যক্ষমতা না বাড়লে সিকোয়েন্সিংয়ের গতি এবং স্বল্প ব্যয় অসম্ভব হতো।
আবার একটি জিনোম একবার সিকোয়েন্সড হয়ে গেলে এটি বিশ্লেষণ করা হয়। বিশেষ করে জিনোমের ভেতরের বৈচিত্র্য শনাক্ত করতে কয়েক বিলিয়ন ডেটা পয়েন্ট বিশ্লেষণ করা হয়। এই বিশ্লেষণ থেকে রোগের কারণ শনাক্ত করতে এবং নিরাময় পদ্ধতি আবিষ্কারে চেষ্টা চলে। এ কাজটি হাতে হাতে করা অসম্ভব। তবে কম্পিউটেশন জীববিজ্ঞানের উন্নয়নের কারণে এটা সম্ভব হচ্ছে। এ ছাড়া জীববিজ্ঞানীরা উদ্ভিদ ও প্রাণীর নানা সমস্যা ও তার মোকাবিলা পরিবেশের সঙ্গে তাল রেখে কীভাবে করা যায়, তার জন্য কম্পিউটেশন সিমুলেশন চালান। এই সিমুলেশনের মাধ্যমে ওই সব জীব সম্পর্কে নানা ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়। যেমন একটি সিমুলেশন ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে ক্যানসার কোষগুলো কোন ওষুধে, কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। সেই সিমুলেশনের ফল থেকে ক্যানসার নিরাময়ের পদ্ধতি আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। আশা করা যায়, এই গবেষণামূলক মডেল এবং সিমুলেশনগুলো রোগের চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারবে।
এদিকে সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তির অগ্রগতির একটি বড় নিদর্শন হলো 23andme–এর মতো হোম-জেনেটিক টেস্টিং কিটগুলোর উত্থান। যদিও এ ধরনের যন্ত্র জিনোমকে সিকোয়েন্স করে না। তবে তাদের সাফল্য এনজিএসের স্বল্প ব্যয়ে এবং আধুনিক সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তিগুলোর সফল ব্যবহারের কারণে সম্ভব হয়েছে।
ডিএনএতে লুকিয়ে থাকা স্বাস্থ্যঝুঁকির তথ্য জানতে এই কিটগুলোর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। এ ধরনের কোম্পানিগুলো তাদের ডেটাবেসে গ্রাহকদের কাছ থেকে পাওয়া হিউম্যান জিনোমের তথ্য সংরক্ষণ করে। তারপর সেগুলোর শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা পদ্ধতি যোগ করা হয়। গ্রাহকেরা নিজের জিনোম সিকোয়েন্স করে এসব ডেটাবেস থেকে নিজের রোগটি শনাক্ত করতে পারেন এবং বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা সিকোয়েন্সিং ডেটা থেকে প্রাপ্ত মিউটেশনগুলোর ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা দেন।
জেনেটিক তথ্যের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন অনলাইন ডেটাবেস এবং ক্লাউড স্টোরেজ প্ল্যাটফর্মগুলোর বিকাশ ঘটেছে। সেসব ক্লাউড স্টোরেজে অ্যাকসেস গ্রাহক ও গবেষকেরা নিতে পারেন এবং সেসব ডেটা বিশ্লেষণও করতে পারেন। আধুনিক ডেটাবেস এবং ক্লাউড স্টোরেজ প্ল্যাটফর্মগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ৪ শতাংশ মানুষ ব্যবহার করেন। স্টোরেজ ক্ষমতা, ব্যাকআপ এবং ক্লাউডভিত্তিক ডেটাবেসগুলোর মাধ্যমে সরবরাহ করা সর্বজনীন অ্যাকসেস চিকিৎসাবিদ্যার কিছু সমস্যা সমাধান করার জন্য একত্রে কাজ করার সুযোগ দেয়।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও এখন অপরাধ দমনে জেনেটিক ডেটার শরণাপন্ন হচ্ছে। ২০১৮ সালে এক কুখ্যাত খুনি পুলিশ গ্রেপ্তার করে জেনেটিক তথ্যের ডেটাবেইস থেকে। খুনির বংশতালিকা আর পারিবারিক জেনেটিক তথ্য একটি সাইটে আপলোড করেছিল তার এক আত্মীয়। সেই তথ্যের সঙ্গে মিলিয়েই খুনিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এখন অনেক দেশেই অপরাধীর জিনোম সিকোয়েন্স করে ডেটাবেসে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও বড় কোনো অপরাধ করলে কিংবা তার পরিবার বা উত্তরসূরিদের কেউ বড় ধরনের অপরাধ করলে তার ডিএনএর তথ্য কাজে লাগবে।
ক্লাউডে এবং পাবলিক ডেটাবেসে সংরক্ষণ করা সঞ্চিত যেকোনো ডেটাতে ঝুঁকি রয়েছে। পাবলিক ডেটাবেইসগুলোতে যে কেউই অ্যাকসেস পেতে পারেন। তাই এগুলো হ্যাক হওয়ার আশঙ্কাও আছে। 23andme-এর মতো কোম্পানির ডেটাবেসেও হ্যাক হতে পারে। তাতে যাদের ডেটা সংরক্ষিত আছে তাদের প্রাইভেসি হুমকির মধ্যে পড়তে পারে। অনেকে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, কারণ তাঁদের জিনের তথ্য নিয়ে সেই ব্যক্তিকে ক্লোন করে ফেলাও অসম্ভব নয়। ডিএনএর সংবেদনশীল, ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের সুরক্ষা এবং গোপনীয়তার সুরক্ষা কেবল কম্পিউটারবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমেই দেওয়া সম্ভব।
জিন সিকোয়েন্সে কম্পিউটার প্রযুক্তি মানবেতিহাসে একটা বড় বিপ্লব ঘটিয়েছে। ২০ বছর আগেও সেটা কল্পনাতীত ছিল। আরও ২০ বছর পর চিকিৎসাবিজ্ঞান আর কম্পিউটার প্রযুক্তির এই যুগল পথচলা মানবসভ্যতাকে আরও অবিশ্বাস্য সাফল্য এনে দেবে, তাতে সন্দেহ নেই।