কৃষি গবেষণায় ন্যানোর প্রযুক্তি
বাংলাদেশের কৃষিতে ন্যানোটেকনোলজি নতুন বিষয়। কেননা, আমাদের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠক্রমে এবং বিষয়বস্তুতে ন্যানোপ্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত নয়। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮-তে কৃষি উন্নয়নে ন্যানোপ্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফসলের রোগ নির্ণয়, জাতভিত্তিক পুষ্টির চাহিদা নির্ণয়, পুষ্টি আহরণের ক্ষমতা বৃদ্ধি; ন্যানো-সেন্সর প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভূমির গুণাগুণ পর্যবেক্ষণ ও উত্পাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ, কৃষি পরিবেশে ভারী ধাতুর উপস্থিতি শনাক্তকরণে ন্যানোপ্রযুক্তি ব্যবহার প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ন্যানোপ্রযুক্তির সার, বালাইনাশক উদ্ভাবন ও ব্যবহারের মাধ্যমে উপকরণ দক্ষতা অর্জনের ওপর গুরুত্বরোপ করায় বিজ্ঞানীদের সমসাময়িক ভাবনায় বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে।
ন্যানোপ্রযুক্তি হলো পারমাণবিক বা আণবিক স্কেলে কাজ করার অতি ক্ষুদ্র প্রযুক্তি। ন্যানোপ্রযুক্তিকে সংক্ষেপে ন্যানোটেক বলা হয়। ১ ন্যানোমিটার সমান ১ মিটারের ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ। কৃষিক্ষেত্রে ন্যানো–ফার্টিলাইজার বা পেস্টিসাইডের ধারণাটা এ ধরনের, অর্থাৎ একের মধ্যে অনেক ব্যবহার। ন্যানোকণা কার্যকরভাবে শস্য সংরক্ষণের জন্য বালাইনাশকের কার্যকারিতা এবং নিরাপদ ব্যবহারে উন্নয়ন ঘটাতে পারে। তেমনি ন্যানো–সার স্নো রিলিজ বা ধীরে ধীরে উদ্ভিদের গ্রহণ উপযোগী হওয়া ও ধীর অবক্ষয়ের মাধ্যমে কার্যকরভাবে সার ব্যবহারের দক্ষতার প্রভূত উন্নয়ন করতে পারে। ন্যানোকণার ব্যবহার অথবা ন্যানো–বাহকের ভেতরে সারের উপাদান ব্যবহার শস্যের বৃদ্ধি ও উত্পাদনশীলতার উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে।
সম্প্রতি ব্যাকটেরিয়াল ও ছত্রাকজনিত সংক্রামক রোগ দমনে করা হয়েছে জীবাণু প্রতিরোধী সোলার রিচার্জেবল ন্যানোতন্তু। আলোক–সংবেদী বিভিন্ন রাসায়নিক যৌগ একত্র করে তৈরি হয় এই তন্তু। এরা দিনের আলোতে ক্রিয়াশীল অক্সিজেন প্রজাতি উত্পন্ন করে রোগজীবাণুকে প্রতিরোধ করতে পারে। ন্যানোপ্রযুক্তির ডিভাইস ও যন্ত্রপাতি যেমন, ন্যানো–ক্যাপসুল, ন্যানোকণা, ন্যানো–রোবট এমনকি ভাইরাস ন্যানো–ক্যাপসিড সুনির্দিষ্টভাবে রোগ নির্ণয় ও চিকিত্সায়, উদ্ভিদ পুষ্টি গ্রহণ ত্বরান্বিতকরণ, সুনির্দিষ্ট স্থানে এবং পানি শোধন–প্রক্রিয়ার উন্নয়নে ব্যবহার করা সম্ভব। উদ্ভিদ প্রজনন ও জেনোমিক রূপান্তরেও ন্যানোকণার ব্যবহার হয়ে থাকে।
ন্যানোকণা ব্যবহারে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ব্যবহারের কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন কিছু ন্যানোকণার পেটেন্ট রয়েছে, অনুমতি ছাড়া এগুলো ব্যবহার করা বেআইনি। কৃষিতে ন্যানোকণা ব্যবহারে আইন ও নীতির অপ্রতুলতা রয়েছে। আমাদের ন্যানোকণার গবেষণায় সামর্থ্যের (মানবসম্পদ ও স্থাপনা) রয়েছে সীমাবদ্ধতা। ন্যানো বিষাক্ততার ভয়ও আছে। কিছু ন্যানোকণা জিন বিবর্তন (মিউটেশন) করতে সক্ষম, ডিএনএ ধ্বংস করে এবং ন্যানো নন-টার্গেটেড জীবের প্রতি বিষাক্ততা তৈরি করতে পারে। সে জন্য কৃষিতে নতুন ন্যানোকণা সূচনার পর্বে এর যথাযথ নিরাপদ ব্যবহারের ওপর গবেষণার যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার পারস্পরিক যোগাযোগ খুবই দুর্বল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মৌলিক জ্ঞান সৃজনের লক্ষ্য নির্ধারণ এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে আবিষ্কৃত নতুন জ্ঞানের বাণিজ্যিকীকরণে রোডম্যাপ তৈরি আশু প্রয়োজন।
এ দেশে ইতিমধ্যে কৃষিতে ন্যানোটেক–বিষয়ক কিছু গবেষণা সাফলতা পেয়েছে। সম্প্রতি বুয়েট ও বশেমুরকৃবির যৌথ গবেষণায় ন্যানোপ্রযুক্তির মাধ্যমে সেলুলোজ দিয়ে তৈরি কাগজে জীবাণুরোধী গুণাবলি যোগ করার কৌশল উদ্ভাবিত হয়েছে। এ উদ্ভাবন আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির জার্নাল এসিএস সাসটেইনেবল কেমিস্ট্রি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এ প্রকাশিত হয়েছে। জীবাণুরোধী সিলভার ন্যানোকণা কাগজের ওপর সংযোজনের জন্য বিজ্ঞানীরা সামুদ্রিক শামুক ও ঝিনুকের মধ্যে থাকা পলিডোপামিন প্রাকৃতিক যৌগের বৈশিষ্ট্য ধার করে। পলিডোপামিনের উপস্থিতির কারণে সমুদ্রের প্রবল ঢেউ উপেক্ষা করেও পাথর ও সমুদ্রপৃষ্ঠের সঙ্গে শামুক ও ঝিনুক নিজেদের শক্তভাবে আটকে রাখতে পারে। উদ্ভাবিত ন্যানোসিলভার কণা–সংযোজিত কাগজ তাই কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ নানা রকম ব্যাকটেরিয়া ও ক্ষতিকারক ছত্রাক দমনে খুবই কার্যকরী হতে পারে।
কৃষি উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে ন্যানোপ্রযুক্তির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। তা সত্ত্বেও ন্যানোপ্রযুক্তির ব্যবহারে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা সমাধানে গবেষণা করা প্রয়োজন। যেমন অধিকাংশ ন্যানোকণার বাণিজ্যিক উত্পাদন কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল কৃষিতে ন্যানোকণা বাণিজ্যিকীকরণে ক্ষতিকারক দিকগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন প্রয়োজন।