এজ কম্পিউটিং ও কম্পিউটিংয়ের সীমাবদ্ধতা

ক্লাউড কম্পিউটিং প্রায় কয়েক দশক ধরেই স্ট্যান্ডার্ড স্টোরেজ ও প্রসেসিং সলিউশন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গুগল ক্লাউড প্ল্যাটফর্ম, মাইক্রোসফট অ্যাজুর ও আমাজন ওয়েব সার্ভিস—তিন টেক জায়ান্টের এই ক্লাউড কম্পিউটিং সলিউশনগুলোর ওপর নির্ভর করে টিকে আছে অগণিত ওয়েবসাইট, অ্যাপ্লিকেশন, গবেষণা ও অন্যান্য আইওটি (Internet of Things or IoT) সেবা।

কিন্তু নতুন নতুন উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির কাছে কয়েক দশকের পুরোনো এই কম্পিউটিং ব্যবস্থা ধীরে ধীরে হার মানছে। নতুন আইওটি ডিভাইসগুলো উচ্চ ব্যান্ডউইডথ ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের ওপর নির্ভরতার কারণে তথ্যের আদান–প্রদানে থেকে যাচ্ছে ব্যাপক লেটেন্সি। ডেটা আদান–প্রদানে এই লেটেন্সি বা ধীরগতি দূর করার জন্যই এজ (Edge) কম্পিউটিংয়ের সূচনা।

ইংরেজি edge শব্দের অর্থ কিনারা, প্রান্ত বা কোনো কিছুর ধার। যেখানে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ে ডেটা সংরক্ষণ ও প্রসেসিং করা হতো দূরদেশের কোনো এক সার্ভারে, এজ কম্পিউটিংয়ে সেই প্রসেসিং হয় প্রাপক ও প্রেরক ডিভাইসের খুব কাছে। বলা যেতে পারে, ডিভাইসগুলোর কাছের কোনো এক কিনারাতেই হয় এই প্রসেসিং।

একটা সহজ উদাহরণ দিই। ধরুন, একটা ফ্যাক্টরিতে গ্যাসের লিক শনাক্ত করার জন্য সেন্সর আছে, যা ইন্টারনেটের মাধ্যমে কাজ করে। সেন্সরটির মূল কাজ হলো ফ্যাক্টরির বায়ুতে কোন উপাদান কী পরিমাণে আছে, সেই ডেটা সংগ্রহ করা। এখন এই আইওটি-বেজড সেন্সরটি যদি ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মাধ্যমে ডেটা প্রসেসিং করে, তবে সেন্সর থেকে ডেটাগুলোকে কয়েকটি দেশ, এমনকি কয়েকটি মহাদেশ পেরিয়ে যেতে হবে রিমোট কম্পিউটিং সার্ভারে, যেখানে ডেটাগুলো প্রসেস করে নির্ধারণ করা হবে ফ্যাক্টরিতে বিদ্যমান গ্যাসের পরিমাণ বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে কি না। যদি তা সীমা অতিক্রম করে ফেলে, তাহলে শত শত মাইল দূরে থাকা রিমোট সার্ভারটি সংকেত পাঠাবে সেই সেন্সরকে এবং সেই সংকেত পাওয়ার পর সেন্সরটি ফ্যাক্টরির অ্যালার্ম ও সেফটি প্রটোকল ট্রিগার করবে, যেন কর্মরত শ্রমিকেরা সময় থাকতেই ফ্যাক্টরি থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন। মাত্রাতিরিক্ত ওই গ্যাস থেকে কোনো অগ্নিকাণ্ড যেন না ঘটে, সে জন্য বন্ধ হয়ে যাবে সব যন্ত্রপাতি।

এই ক্ষেত্রে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ে ব্যবহৃত রিমোট সার্ভারগুলো যত দূরে হবে, সেন্সর থেকে প্রসেসিংয়ের জন্য ডেটা পাঠাতে ও প্রসেসিংয়ের পর প্রাপ্ত ফলাফল পুনরায় সেই সেন্সরিং ডিভাইসে ফেরত আসতে ঠিক তত বেশি সময় লাগবে। আর এই পুরো প্রক্রিয়ায় সময় যত বেশি লাগবে, ফ্যাক্টরিতে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও তত বাড়তে থাকবে।

কিন্তু যদি সেন্সরটির সঙ্গে কিংবা ফ্যাক্টরিতেই কোথাও একটা কম্পিউটিং ডিভাইস স্থাপন করা যায়, তবে সেন্সর থেকে ডেটা আদান-প্রদান ও প্রসেসিংয়ে প্রয়োজনীয় সময় অনেকাংশেই কমে আসবে। ফলে দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে আরও সহজেই।

একটা প্রসেসিং ও স্টোরেজ ইউনিট ওই সেন্সরের খুব ধারে ইনস্টল করার মাধ্যমে পুরো প্রসেস সম্পন্ন হতে প্রয়োজনীয় সময় কমার পাশাপাশি কমবে ব্যান্ডউইডথ খরচও।

এ কারণেই দিন দিন এজ কম্পিউটিং জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে ও ছোট–বড় প্রায় সব কোম্পানি তাদের ইন্টারনেট-বেজড সার্ভিসের জন্য ইন-হাউস বা ইন-ডিভাইস প্রসেসিং ও স্টোরেজ ইউনিটের সাহায্য নিচ্ছে।

আমাদের ব্যবহারিক জীবনেও এজ কম্পিউটিংয়ের দেখা মিলছে। দৈনন্দিন জীবনে এজ কম্পিউটিংয়ের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার ও সুফল আমরা দেখতে পাই মুঠোফোনে।

যখন ফোন থেকে আমরা কোনো কিছু সার্চ করি বা কোনো ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে যাই, তখন আমাদের কয়েক সেকেন্ড, ক্ষেত্রবিশেষে কয়েক মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এর কারণ হলো, আমরা ফোন থেকে কোনো কিছু জানতে চাইলে সেই কোয়েরি বা জিজ্ঞাসাটিকে প্রথমে পৌঁছাতে হয় শতসহস্র মাইল দূরের কোনো এক সার্ভারে। পরে সেই সার্ভার আমাদের জিজ্ঞাসাটি গ্রহণ করে এবং জিজ্ঞাসা অনুযায়ী ওয়েবসাইটের তথ্য পাঠায় আমাদের ফোনে। এই প্রক্রিয়া পুরোটাই হয় ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মাধ্যমে।

কিন্তু ফোনের এমন কিছু কাজ আছে, যা ফোনের ভেতরেই প্রসেস করা হয়। আইফোনের ফেসিয়াল রিকগনিশন বা চেহারা শনাক্ত করার প্রোগ্রাম এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

আইফোন যদি এই ফেসিয়াল ডেটা ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মাধ্যমে ভেরিফাই করত, তবে প্রথমে ফোনকে গ্রাহকের চেহারার ছবি নিয়ে পাঠাতে হতো বহু দূরের কোনো সার্ভারে। সেখানে সেই চেহারার ছবি মেলানো হতো আগে থেকে ব্যবহারকারীর সংরক্ষিত থাকা ছবির সঙ্গে। যখন ব্যবহারকারীর চেহারার সঙ্গে সদ্য তোলা ছবির মিল পাওয়া যাবে, তখন সেই সার্ভার থেকে ফোনে খবর পাঠানো হবে, ফোনটি ব্যবহারকারীর জন্য আনলক করে দেওয়ার জন্য। এভাবে ফেসিয়াল ডেটা বা ছবি সার্ভারে পাঠানো থেকে শুরু করে প্রসেসিং ও ফলাফল ফোনে আসতে সময় লেগে যেত কয়েক সেকেন্ড।

কয়েক সেকেন্ড আপাতদৃষ্টিতে অনেকের কাছেই কম মনে হতে পারে। কিন্তু একবার চিন্তা করুন, আপনাকে যদি নিজের ফোন আনলক করতে প্রতিবার ৫-১০ সেকেন্ড অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে কী পরিমাণ বিরক্ত হবেন আপনি?

এ জন্যই অ্যাপল তাদের ফোনের মধ্যেই ফেসিয়াল ডেটা ভেরিফাই করার জন্য তাদের এ সিরিজ এবং এম সিরিজের চিপে ডেডিকেটেড প্রসেসিং ইউনিট রেখেছে। এতে ফোনের সেন্সর থেকে পাওয়া চেহারার প্রতিকৃতি ব্যবহারকারীর সংরক্ষিত চেহারার সঙ্গে মেলানো যাচ্ছে ফোনের মধ্যেই। ফলে ৫-১০ সেকেন্ড অপেক্ষা করার বদলে মুহূর্তেই আনলক হচ্ছে ফোনটি।

এ ছাড়া ফোনে এজ কম্পিউটিংয়ের আরও একটি বহুল প্রচলিত প্রয়োগ হলো, ফোনের ভার্চ্যুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টগুলোর ট্রিগার বা ওয়েক আপ কল ডিটেকশন। গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট, অ্যালেক্সা ও সিরি প্রতিটিরই আলাদা আলাদা ওয়েক আপ ফ্রেজ; অর্থাৎ সক্রিয় করার জন্য নির্দিষ্ট বাক্যাংশ আছে। যেমন ‘ওকে গুগল’, ‘অ্যালেক্সা, ‘হেই সিরি’ ইত্যাদি। এসব বাক্যাংশ শনাক্ত করার জন্য যদি ক্লাউড কম্পিউটিং ব্যবহার করা হতো, তবে ফোনের অ্যাসিস্ট্যান্টগুলো থেকে প্রয়োজনীয় জবাব পেতে সময় লাগত আরও অনেক বেশি। কিন্তু এজ কম্পিউটিং ব্যবহারের ফলে এসব ওয়েক আপ ফ্রেজ শনাক্ত করা যাচ্ছে সেই ফোনেই, যাতে এই ভার্চ্যুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টগুলো পরবর্তী আদেশ শোনার জন্য মুহূর্তেই প্রস্তুত হয়ে যায়।

এভাবে এজ কম্পিউটিংয়ের মাধ্যমে লেটেন্সি ও ব্যান্ডউইডথ খরচ কমিয়ে ইন্টারনেট-বেজড সার্ভিসগুলোকে করা হচ্ছে ইনস্ট্যান্টেনিয়াস বা তাৎক্ষণিক। রিয়েল টাইম ডেটা কালেকশন ও মনিটরিংও সম্ভব হচ্ছে এই এজ কম্পিউটিংয়ের কারণে।

তবে এই প্রক্রিয়ায় ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের সীমাবদ্ধতা দূর করা হলেও, এজ কম্পিউটিংয়ের নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতা আছে।

যখন ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মাধ্যমে প্রসেসিং ও ডেটা জমা রাখা হয়, তখন সেই ডেটা সুরক্ষিত থাকে দূরের কোনো সার্ভারে। কিন্তু এজ কম্পিউটিংয়ে সেই প্রসেসিং ও ডেটা জমা রাখা হয় ডেটা কালেক্টিং সেন্সরে, মানে যন্ত্রের ভেতরে। যেহেতু সার্ভারটি খুব কাছে ও হাতের নাগালেই থাকে, সঠিক টুল ব্যবহার করে যে কেউই সেই এজ প্রসেসিং সার্ভারের তথ্য দেখতে, কপি করতে, এমনকি পরিবর্তনও করতে পারে। তাই সিকিউরিটির চিন্তা করলে এজ প্রসেসিং ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মতো ততটা সুরক্ষিত নয়।

এই অসুরক্ষিত প্রসেসিং ও স্টোরিং ব্যবস্থার জন্য এজ কম্পিউটিং ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের সীমাবদ্ধতা দূর করতে পারলেও, ক্লাউড কম্পিউটিংকে সরিয়ে এর জায়গা ঠিক এখনই নিতে পারবে না।

এর সমাধান হতে পারে একধরনের এজ ক্লাউড হাইব্রিড কম্পিউটিং ব্যবস্থা, যেখানে প্রাথমিক প্রসেসিং ও ডেটা শর্ট করা হবে কাছের সার্ভারে এবং জটিল প্রসেসিং ও ডেটা স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা হবে দূরের ক্লাউড কম্পিউটারে। প্রাথমিক প্রসেস এজ কম্পিউটিংয়ের সাহায্যে হওয়ার ফলে কমে আসবে প্রসেসিংয়ের সময়, যা ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের বিশেষ দুর্বলতা। এ ছাড়া ডেটা স্থায়ীভাবে রিমোট সার্ভারে সংরক্ষিত থাকার ফলে এজ কম্পিউটিং ব্যবস্থার মতো ডেটার সুরক্ষা নিয়েও চিন্তা করতে হবে না। এই হাইব্রিড কম্পিউটিং ব্যবস্থায় এজ কম্পিউটিং ও ক্লাউড কম্পিউটিং হবে একে অপরের পরিপূরক।

At HAMKO Future Tech Academy We are dedicated to shaping the future of technology by equipping students with the skills and knowledge needed to excel in the dynamic world of industrial attachment and freelancing programsHAMKO Future Tech Academy

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here