আদালতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার অনিরাপদ

আদালতের কিছু বিচারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিচারব্যবস্থায় বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ব্যবহৃত হচ্ছে। বিগডেটা, অ্যালগরিদম ও মেশিন লার্নিংয়ের দ্রুত বিকাশ ও ক্রমবর্ধনশীল অগ্রগতি আদালতে এআই প্রযুক্তির ব্যবহারকে ত্বরান্বিত করেছে। মূলত ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় প্রবেশন, জামিন, সাজার মেয়াদ নির্ধারণ ও অপরাধপ্রবণতা নিরূপণ করার কাজে ‘সিদ্ধান্তসহায়ক প্রযুক্তি’ এআই অ্যালগরিদম ব্যবহার করা হয়। এমন যান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অপরাধীর ঝুঁকি মূল্যায়ন অ্যালগরিদম বা প্রমাণভিত্তিক পদ্ধতিও বলা হয়ে থাকে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর এমন প্রযুক্তি বেছে নেওয়ার কিছু যুক্তি আছে। যেমন বিচারকের যুক্তি, অনুধাবন ও সিদ্ধান্তে যে সহজাত পক্ষপাত এবং গোপন বৈষম্য থাকে, তা দূর করে ফৌজদারি আদালতের বিচারপ্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতা ও বৈজ্ঞানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। যেহেতু কম্পিউটার মানুষ নয়, কম্পিউটার বা মেশিনের সেই সমস্যা নেই, যা মানুষের আছে। প্রযুক্তি আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ—এই বিতর্ক পুরোনো হলেও আদালতের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিমণ্ডলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের প্রভাব নিয়ে বিশ্বব্যাপী নতুন বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

এমন এক অভিনব বিতর্ককে উপজীব্য করে ফৌজদারি আদালতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের প্রভাব বিষয়ে গবেষণা করেছেন দেশের অধস্তন আদালতের এক বিচারক। রাজশাহীর সহকারী জজ মো. আবদুল মালেক। তিনি দেখিয়েছেন, ফৌজদারি আদালতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার কীভাবে বৈষম্য ও পক্ষপাতের ঝুঁকি তৈরি করে, এ বিষয়ে আইন ও বিচার, প্রযুক্তিনীতি ও নৈতিকতার সংমিশ্রণে এক আন্তবিষয়ক গবেষণাকর্ম সম্পন্ন করেছেন। যা ইতিমধ্যে স্বনামধন্য স্পিঞ্জার নেচার-এর এআই অ্যান্ড এথিক নামের জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।

অপরাধীকে প্যারোলে বা প্রবেশনে মুক্তি দেওয়া যাবে কি না, আসামি জামিনে মুক্তি পেলে সে সমাজে ফিরে আবার অপরাধ করার সম্ভাবনা আছে কি না অথবা জামিনে মুক্ত আসামি নিয়মিত আদালতে শুনানিকালে হাজির হবে কি না এবং প্রমাণিত অপরাধের দণ্ডের মেয়াদ কত হবে—এমন সব প্রশ্নে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করা হয়। এসব ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা পরিচালিত রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট অ্যালগরিদম আদালতকে স্বয়ংক্রিয় সংকেত দেয়। এমন স্বয়ংক্রিয় সংকেত কীভাবে বিচারককে নানাভাবে প্রযুক্তিগত পক্ষপাত ও বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে প্রভাবিত করে, এ গবেষণায় এমন সব বিষয় নিবিড়ভাবে পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

মূলত হালে প্রচলিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় চালিত রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট মেশিনগুলোতে বিপুল পরিমাণ ডেটা ইনপুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মো. আবদুল মালেক তাঁর গবেষণায় উল্লেখ করেন, এ ধরনের স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমে অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধমূলক ইতিহাস, বয়স, লিঙ্গ, বৈবাহিক ও পারিবারিক সম্পর্ক, জীবনযাত্রার মান ও শিক্ষা ইত্যাদি সম্পর্ক অসংখ্য ডেটা সংগ্রহ, ব্যবহার ও বিশ্লেষণ করা হয়। এ ধরনের ডেটা আমাদের অতীত সমাজের পক্ষপাত ও বৈষম্যমূলক ডেটা। উপযুক্ত গবেষণা এই কারণে বলছে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় পরিচালিত যন্ত্রে পক্ষপাতদুষ্ট ডেটা ব্যবহারের কারণে প্রযুক্তিগতভাবেই নানা ধরনের লুকানো বৈষম্য ও পক্ষপাত বিদ্যমান থাকার মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। তাই অবাঞ্ছিত ফলাফল হিসেবে নানা ধরনের মেশিন বা যান্ত্রিক বৈষম্য নতুন রূপে সমাজে আবির্ভাব হতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ আবদুল মালেক আরও দাবি করেন যে বর্তমানে ফৌজদারি আদালতে ব্যবহৃত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংস্করণটি প্রকৃতিগতভাবেই পক্ষপাতমূলক ডেটা দিয়ে তৈরি এবং প্রশিক্ষিত। তাই অভিনব পক্ষপাত, যেমন প্রযুক্তিগত পক্ষপাত, ডেটাসেট পক্ষপাত, নমুনা পক্ষপাত, অটোমেশন পক্ষপাত, নিশ্চিতকরণ পক্ষপাত, প্রতিনিধিত্ব পক্ষপাত এবং মিথস্ক্রিয়া পক্ষপাতের মতো নেতিবাচক প্রভাব ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে আরও বৈষম্যমূলক ও পক্ষপাতদুষ্ট করে তুলবে। ফলে এ ধরনের প্রযুক্তি নিয়ে আইনি ও নৈতিকতার প্রশ্নে গভীর উদ্বেগ রয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরূপ অনাকাঙ্ক্ষিত পক্ষপাতসমূহ ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার প্রাসঙ্গিকতায় বিশেষভাবে অন্বেষণ এবং পরীক্ষা করেছেন এই বিচারক গবেষক। পাশাপাশি বিষয়বস্তু আলোচনায়, আমেরিকার বিখ্যাত লুমিস কেস (২০১৬) ও বিচারকদের করণীয় সম্পর্কে আদালতের পর্যবেক্ষণগুলো বিশেষভাবে আলোচনা করা হয়েছে এই গবেষণা প্রবন্ধে।

ব্যক্তির অধিকার, বিচারিক মূল্যবোধ ও ন্যায্যতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বিধায় ফৌজদারি আদালতে এআই প্রযুক্তি অন্ধভাবে ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছেন রাজশাহীর এই বিচারক। এ ছাড়া তিনি আশঙ্কা করেছেন যে ফৌজদারি আদালতে এআই মেশিনকে অন্ধভাবে ব্যবহার করা হলে আদালতে অমানবীয় ‘মেশিন কর্তৃত্ব’ স্থাপিত হতে পারে। কেননা, সারা বিশ্বে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সামরিক ও সামাজিক কল্যাণের মতো সরকারি খাতগুলোতে ব্যবহৃত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বর্তমান সংস্করণ এখনো মানুষের ভুলভ্রান্তি, বৈষম্য এবং পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ সংশোধন করতে সক্ষম নয় মর্মে এই গবেষক মনে করেন।

এ ছাড়া আদালতের মতো সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের দরুন তৈরি হওয়া সমস্যা সমাধানের সম্ভাব্য উপায় যুক্তিসহ উপস্থাপন করা হয়েছে এ গবেষণাপত্রে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিচারাঙ্গনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ও তার প্রভাববিষয়ক এই গবেষণা শুধু বাংলাদেশ নয়, হাল বিশ্বে চলমান এআই প্রযুক্তি নিয়ে নানামুখী বিতর্কের এক অনবদ্য অংশ। বাংলাদেশি কোনো অধস্তন আদালতের বিচারক হিসেবে এমন জটিল ও আন্তবিষয়ক গবেষণা সম্পন্ন করা এবং তা আবার বিশ্বমানের একটি জার্নালে প্রকাশ করা সত্যিই যেমন অনেক চ্যালেঞ্জিং, তেমনি অনেক আনন্দেরও বটে। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের সময়োপযোগী ও ভিন্নধর্মী গবেষণালব্ধ জ্ঞান বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও ফলপ্রসূ প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তা ছাড়া এ ধরনের প্রযুক্তির উন্নয়ন, ব্যবহার, গবেষণাসহ বিচার প্রশাসনের নীতিনির্ধারণে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।

At HAMKO Future Tech Academy We are dedicated to shaping the future of technology by equipping students with the skills and knowledge needed to excel in the dynamic world of industrial attachment and freelancing programsHAMKO Future Tech Academy

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here